মহালয়ার শুভেচ্ছা


সকালে ঘুম ভাঙতেই বার্তা এলো "মহালয়ার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নাও"। চোখের সামনে সুচেতা'দির মায়াবতী মুখটা ভেসে উঠলো, শুরু হলো শুভেচ্ছাময় স্নিগ্ধ একটা দিনের।

বৃষ্টি বৃষ্টি মেঘলা দিন। দিদির পাঠানো শুভেচ্ছায় বারে বারে চলে যাচ্ছিলাম পূজোর সব আনন্দ-স্মৃতিতে। দিদির মুখ ভাবতে ভাবতে খুব মনে পড়লো মাসীমার কথা। ভীষন মিষ্টি চেহারার আমাদের মাসীমা-- তাঁতের পাড়ওয়ালা শাড়ী, দু'হাতে শাখা আর পলা, সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর আর বেশ বড়সড় একটা টকটকে লালরঙা সিঁদুরের টিপ--এই আমাদের পুরো দস্তুর বাঙালী মাসীমা, আমাদের কেমিস্ট্রি টিচার সুশান্ত স্যারের গিন্নী। স্যারের মেয়ে শিল্পী ছিলো আমাদের বন্ধু। কলেজের সময়টায় প্রতিটা পূজায় মাসীমাকে না জ্বালালে যেন চলতোই না আমাদের বন্ধুদের। এরকম বৃষ্টি দিন উপেক্ষা করে ঠিক হাজির হতাম সুশান্ত স্যারের বাসায়। খটোমটো রসায়ন ক্লাস বাদ দিয়ে তাঁরই বাসায় বসে রস আনয়নের কাজটা আমরা নিজেরাই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করতাম। খাটের ওপর এলোমেলো বসে উলটাপালটা আড্ডা, একটু পর পর কি কি জানি নানান রকমের তেলে ভাজা মুচমুচে বড়া নিয়ে আসতেন মাসীমা আর আমরা কত তাড়াতাড়ি শেষ করব সেই প্রতিযোগীতায় নামতাম যেন। এদিকে টিভিতে চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে শিল্পীর হঠাৎ চিৎকার শুনে মাসীমা দৌড়ে এলেন একবার, "কি হয়েছে?!" "না মা, শাহরুখ খানকে দেখে!" আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ছি আর মাসীমা গজগজ করতে করতে বলতে লাগলেন, "মা গো, শাহরুখ খানকে দেখে যে চিৎকার দিয়েছিস, ভগবানকে দেখেও তো দিবি না!"

মাসীমা এখন ঢাকায় থাকেন, অথচ এক শহরে থেকেও এখন আর যাওয়া হয় না একেবারেই। শিল্পীর বিয়ে হয়ে গেছে, মাসীমার মত অত মোটা করে নয়, ও সিঁদুর দেয় খুব চিকন করে, একটা কাঠির মাথায় একটুখানি সিঁদুর ছুঁইয়ে। আমার নিজের সিঁদুর খুব পছন্দের সাজ। কেমন একটা স্নিগ্ধ বাঙালীয়ানা যেন প্রকাশ পায় এতে। পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন, অথবা জগন্নাথ হলের পূজা দেখতে যাবার সময় যখন তাতের শাড়ি পড়ে খুব সাজি তখন সাথে সিঁথিতে সিঁদুর আর কপালে বড় একটা লাল টিপ না হলে যেন চলেই না। এরকম সেজে একবার ছবি তুলেছিলাম একটা, মা'র এত পছন্দ হলো, বড় করে বাঁধিয়ে রাখলেন ঘরের দেয়ালে। এরপর অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের বাসায় কোন আত্মীয় এলেই চোখ কপালে তুলে বলেছে, "ওমা, সিঁদুর পরেছে কেন?! এ তো পাপ! " মামণি বলতো, "সাজার জন্য পরেছে, কি হলো তাতে?"

রোজা এসে গেলো। ক'দিন ধরে নিজেরটা বাদ দিয়ে মা'র জায়নামাজে নামাজ পড়ছি। আজ নামাজে দাঁড়িয়েও মা'র কথাই মনে হচ্ছিলো কেবল। ছোটবেলায় একবার খুব মন খারাপ করে মা'কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আম্মু, রাধা কি কখনও বেহেশতে যাবে না?" মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। তারপরে খুব হেসে বলেছিলো, "কে বলেছে তোমাকে এসব? আমরা আমাদের মত করে আল্লাহকে ডাকি। আর ওরাও কত ভক্তি করে ওদের ঈশ্বরকে। যদি সত্যি সৃষ্টিকর্তা বলে একজন থাকেন, তিনি কেমন করে কার প্রার্থনা শুনবেন, তুমি-আমি কি বলতে পারি?" কতখানি বুঝেছিলাম মনে নেই, তবে সেই ছোট্টবেলায় খুব শান্তি পেয়েছিলাম কথাটা শুনে।

সেই শান্তিটাই বিশ্বাস হয়ে গেঁথে আছে আজো মনের মাঝে।

------------------------------------------------------------------
এই লেখাটা গত বছর পূজোর সময় লিখা। নিজের স্মৃতি নিজের কাছে বড় ভালো লাগার। তাই নিজের পাতায় এবারের পূজোর ক'দিন বাদে আবার তুলে রাখলাম।

Comments

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

দ্বিধা

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ