বোধ

একটু আগে রুমের শেষ জেগে থাকা সদস্য হিসেবে আলো নিভিয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়েছি। সোজা ঘরের সিলিংয়ে চোখ। এরপর দৃষ্টির ভ্রমণ। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার পাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ, পূর্ণিমার আলোয় তার কি অপূর্ব ছায়া পড়েছে ঘরের দেয়ালে! আলোছায়ার এই সৌন্দর্য আজ বহু দিন পরে যেন আবার নজরে এলো আমার। আমার বেকার জীবনের অবসান হবে খুব শীঘ্রি, এর'চে শান্তির ভাবনা আর কি হতে পারে আমার জন্য?

ঠিক পাশের বেডে বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছে আমার বন্ধু রতন। বাপস, একটা মানুষের ঘুম এত গাঢ় হয়,রতনকে না দেখলে ধারণাই থাকতো না আমার। আটপৌরে জীবনযাত্রার জল-খাবারের মত স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া অসংখ্য ইতিহাস আছে আমাদের বন্ধুত্বের, ইউনিভার্সিটির এবং হল-জীবনের এই ৭ বছরে। সবাই বলে রতন-স্বপন মাণিকজোর। আজ এই মাঝ রাতে জরুরী একটা সময়ে কেন সেই ভাবনার আদিখ্যেতা আমাকে বিব্রত করছে বুঝতে পারছি না।

অন্ধকারে উঠে বসি আমি নিজের অজান্তে। নাহ, দ্বিধাটা সরাতেই হবে মন থেকে। কিচ্ছু করার নেই, আর কোন উপায় নেই আমার কাছে। ফজলু ভাইকে কথা দিয়েছি, কালকের মধ্যে টাকাটা তার হাতে দিতেই হবে; নইলে এই চাকরীটা পাবার আশাও ছাড়তে হবে আমাকে।

রতনের বালিশের নিচে রাখা চাবিটা বের করে আনা কোন ব্যাপারই না আমার জন্য। কাংখিত জিনিসটা কোথায় সেটা খুব ভালো করে জানা আছে আমার। সেটা বের করে আনার আগে চাবি হাতে তবু কয়েকটা মুহুর্ত নষ্ট হলো আবার। মনে পড়লো রতনের কথা, গতকালই এই সোনার হারটা কিনেছে সে। কিনে সবার আগে আমাকেই দেখিয়েছে। "বুঝলি, আমার পুচকি বোনটা বড় হইয়া গেলো! দেখতে শুনতে ভালো তো, বিয়াশাদির প্রস্তাব আসতেসে খালি। কবে যে ফুট কইরা চইলা যায় আমগো রে ফালাইয়া! টিউশ্যনির টাকা থেইকা সেই ফার্স্ট ইয়ার থেইকা ওর জন্য কিছু টাকা বাঁচাইছিলাম। অবাক হইছস না? আমার মত খরুচে পোলা কেমনে এত দিন ধইরা জমাইলাম এই টাকা তাই ভাবতেছস? বোনটা বড় আদরের রে, খুব আদরের"। কথা শেষ করে আশ্চর্যজনকভাবে শার্টের হাতায় চোখ মুছেছিলো রতন। আমার অবাক হবার ক্ষমতাও হার মেনেছিলো ওর এই কান্ডে। জীবনে অত ভালোবাসা কারো জন্য জমা থাকতে পারে সেই ধারণাই আমার ছিলো না!

চাবিটা আগের জায়গায় আবার রাখার পরেও রতনের ঘুম ভাঙ্গেনি, জানতাম। আগামীকাল ভোরে ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির ট্রেন ধরার আগে গুছিয়ে রাখা ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে নেবার আগে একবার চেক করেও দেখবে না আমার বোকা বন্ধুটা, সেও জানি। এইসব ভাবনা কেন আমি ভাবছি? আমার উচিত স্বস্তির একটা বিশাল নিঃশ্বাস ফেলা। আমার চাকরীটা হয়ে যাবে এবার নিশ্চিত, ফজলু ভাই কথা দিয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করি একটা শান্তির ঘুমের আশায়, বুজে থাকা চোখের কোন থেকে অকারণে গড়িয়ে পরে কি যেন একটা, আমি পাত্তা দেই না - আর কখনও দেবও না।

Comments

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

দ্বিধা

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ