হৃদয়পাত্র উচ্ছ্বলিয়া


একটানা বেজে চলা টেলিফোনটা ধরতে ইচ্ছা করছেনা কেন জানি। অলস সময়টা রোজকার মত আজ একঘেয়েও মনে হচ্ছে না, বরং সব বাদ দিয়ে অলসতাটাকেই আঁকড়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে যেন। টেলিফোনের ওপাশে মেয়েটা নিশ্চয়ই চিন্তায় অধীর হচ্ছে, তা হোক না একদিন--রোজ সেই একই নিয়ম, অফিসে বসে দুপুরের খাবারের ফাঁকে মায়ের খোঁজ--আজ নাহয় সে একটু চিন্তায় পড়ুক।

আজ দিনটার শুরুই যে অন্য রকম, আজ ভাঙুক সব নিয়ম।

বারান্দার ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে আজ বহুদিন পরে বিকালটাকে বড় সুন্দর মনে হলো আমার। বিকালের নরম হলুদ আলো বুঝি সত্যি এত সুন্দর হয়! কতদিন আমি দেখিনি, কতদিন চোখ বুঝে ছিলাম, কত বছর?

পাশে রাখা সাদা খামটার দিকে চোখ পড়ে আবার। আজই সকালের ডাকে হাতে এলো। প্রাপকের নাম বরুণা। চমকে উঠেছিলাম, এই নামে আমাকে কেউ ডাকে না আজ কত বছর!

...তারপর...তীব্র আবেগে সংবরনহীন জলোচ্ছ্বাস। না, আজ আর কোন খেদ নেই, কোন অভিযোগ নেই আমার জীবনের কাছে। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কি অপূর্ব উপহার, কি শান্তি! পূর্ণতা।

আজ সেই চিঠি এলো, যার প্রতিক্ষায় দিন গুনেছি আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে। যে কথার শুণ্যতায় এত বছরের পূর্ণ সংসারে সব থেকেও কিসের এক অপূর্ণতা ঘিরে ছিলো আমাকে--আজ তা-ই রঙীণ ঘুড়ির মত উড়ে উড়ে আমার দরজায় আটকা পড়েছে...আর কি চাইবার থাকলো আমার জীবনের কাছে?

"বরুণা,
খুব চমকে গেছো বুঝি আজ এতদিন পরে আমার চিঠি পেয়ে! অথবা উলটোটাও হতে পারে, হয়তো বিরক্ত, কিছুটা বিব্রত। কিন্তু এতটা বয়সে, এত দিন পরে তোমাকে লিখতে গিয়ে আমার কিন্তু চমক, বিরক্তি বা বিব্রতবোধ--এর একটাও হচ্ছে না।

দেশে গিয়েছিলাম গত বছর, কি আশ্চর্য অঞ্জনের মৃত্যুর খবর আমি সেবার মাত্র পেলাম জানো? তখনই তোমাকে লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি এক অস্বস্তি, যা এতগুলো বছরে তোমার থেকে আমাকে দূরে রেখেছিলো -- আবারো আমাকে আটকে দিলো। থাক সে কথা। তোমার মেয়ে কেমন আছে? অনেক বড় হয়েছে নিশ্চয়ই? তোমার মত মুখ আর অঞ্জনের মাথা পেয়েছে শুনলাম নীলার কাছে।

আমার ছেলেমেয়ে দুটোও খুব ভালো, আমার মত নয়, নীলারই মত- ভাগ্যিস, আমার মত হলে নীলাকে একসাথে তিনটা পাগল সামলাতে হোত!

বরুণা, আজকাল শরীর ভালো থাকে না জানো? বয়স ধরে ফেললো বুঝি আমাকেও। সব সময়ের হাসিখুশি থাকা এই আমি মাঝে মাঝেই বড্ড আনমনা হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। অতীত মনে পড়ে কেবল। মনে পড়ে দেশের কথা, আমার মফস্বলের শান্তিমাখা কৈশোর, প্রথম যৌবনের ইউনিভার্সিটি জীবন, প্রথম চাকরী স-ব। আর মনে পড়ে খুব ছোট্ট একটা সময়ে বিদ্যুতের মত আমার জীবন ঝলকে দেয়া তোমার কথা! বয়স বাড়লে বুঝি এমনই হয়? যা কিছু চলে গেছে তার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কেবল বারবার? তোমারও কি তাই হয় বরুণা?!

কত কিছু বলছি কেবল, থাক আজ। তুমি ভালো থেকো, ঠিক তোমার নিজের মত করে।

ইতি,
অরুনাভ।

পুনশ্চ: কেন আমি এমন হয়েছি বল তো? যে কথা বলব বলে আজ এত দিন পরে তোমাকে লিখতে বসেছি, এখনও তাই বলা হলো না! বরুণা, সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম জানি। কিন্তু আজ জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে যে কথা বলা অর্থহীন, তাই খুব বলতে ইচ্ছা করছে... বরুণা--তুমি জানো না, আমিই জানতে দিই নি, আজ বলছি, তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।

-------------------------------------------------------
ইন্সপায়ার্ড বাই গি দ্য মোঁপাসা।

Comments

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন