হয় না এমন হয় না...

চার মাস ধরে দেশছাড়া আছি। এমনি এমনি ঘরে বসে থাকি। ঠিক এমনি এমনি না অবশ্য, জীবনে যা কোনদিন করি নি তাই করি - ঘরগেরস্থালী। বেশ লাগে। এই পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমাকে কখনও কোন ক্ষেত্রে কোন গুরুদায়িত্ব নিতে হয় নি। পরিবারের সবার ছোট আল্লাদী মেয়ে, তাই সমস্ত ঝামেলা থেকে দূরেই থেকেছি সব সময়। বড় আপু, ছোট আপুকে দেখেছি মা'র কাজে সাহায্য করতে, আমাকে কখনও সেসব ছুঁতে দেয়া হয় নি ছোট বলে। অথবা ঘরের বাইরে যাসব কাজ, কত কিছুই থাকে না? আমাকে সেসবও করতে দেয়া হয় নি। নিজের দায়িত্বটুকুও কেমন করে যেন নিতে হয় নি কখনও। বাবা-মা, দুই বোন, এমনকি বন্ধুরাও কেমন আদর করে আগলে রেখেছে আমাকে সব সময়। ইউনিভার্সিটির প্রথম তিনটা বছর যখন তারেক ছিলো, মোটামুটি চোখ বন্ধ করে হেঁটেছি আমি সবখানে, নিশ্চিত নির্ভরতায়।

এইবার, বিয়ের ছয় মাস পরে সংসার শুরু করে জীবনে প্রথম দায়িত্ব নিতে শিখলাম আমি। আশ্চর্য একটা দায়িত্ববোধ আপনা থেকেই ভর করলো আমার ওপর। মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা- অন্ন। অতএব রান্নাবান্না দিয়ে শুরু হলো। কুটুর কুটুর করে কত কি রাঁধি। ট্রাডিশনাল রান্নার বাইরে এখান থেকে সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে ডিফরেন্ট কিছু করার ট্রাই করি, কখনও নিজে নিজে বানিয়ে কিছু করি। রান্নার মত একটা বিষয়ে হঠাৎ করে নিজের এরকম আগ্রহ দেখে মাঝে মাঝে নিজেই ভুরু কুঁচকে ভাবি, ঘটনাটা কি?

এই সব করে করেই যাচ্ছিলো। কিন্তু আরো কিছু একটা করা দরকার, যাকে বলে উপার্জন, নিজে নিজে- এরকম ভাবছি অনেক দিন ধরেই। টুকটাক চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম ইন্টারনেট ঘেটে। ইন্টারভিউ দিলাম সেদিন একটা, মোটামুটি রেসপন্স মিললো। ট্রেনিং-এর জন্য ডাক। তারপর ক'দিন কাজ করে দেখাতে হবে, পারফর্মেন্স ভালো হলে কাজ পাক্কা, নইলে ফুটো। আমি মোটামুটি ফুটে যাবো এরকম প্রস্তুতি নিয়েই আজকে প্রথম দিনের ট্রেনিংটা করে করে এলাম। সব অন্য রকম মানুষ, বৈদেশি। আমার কেমন ভয় করছিলো। ছোটবেলায় যেমন প্রথম স্কুলে যাবার সময় মায়ের আঙ্গুল ধরে স্কুলে যেতে ইচ্ছা করত, তেমন ইচ্ছা করছিল আজকে তারুর হাত ধরে ওখানে বসে থাকব। কেউ আমাকে কিছু বললেই তারু দিবে মাইর! হি হি। কিন্তু সেসব তো আর হয় না আসলে। যেতে হলো একাই। বকর বকরও করতে হলো, কারণ জবটা কল সেন্টার কাস্টমার সার্ভিস। কি যে জ্বালায় পড়লাম, আমি দুনিয়ার অন্তর্মুখী কম কথা বলা মানুষ, আর আমি কিনা...

কোম্পানীটা ইন্ডিয়ান। যাদের কাজে ডেকেছে তারা সবাই-ই ইন্ডিয়ান, আমি একা এক বাংলাদেশী। অনেক চটপটে ছেলেমেয়েগুলো। বয়সে আমার থেকে কম বই বেশি নয় কেউই। কি সুন্দর পটপট করে কথা বলে যাচ্ছিলো। আর আমি মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকি। মাঝে মাঝে একটা দুইটা কথা বলি। স্বভাব। বন্ধু-বান্ধব আর খুব পছন্দের মানুষ ছাড়া কথার খই আমার না ফুটেই বসে থাকে। তিন দিনের ট্রেনিং, ভালোই চলছে। হাসিখুশি ছেলেমেয়েগুলোর সাথে বসে থেকে, কথা বলে ভালোই লাগছিলো বেশ। ট্রেনিং শেষে দরজার বাইতে পা-টা রেখেই দুম করে গেলো মনটা খারাপ হয়ে। এরা সবাই বাঙালী হত, এরা আমার সেই সব চেনা বন্ধুরা হত...আমি কত শান্তি পেতাম তাহলে! তাই কি আর হয়? হয়? হয় না তো!

Comments

shondhabati said…
কল সেন্টারে এপ্লাই করেছিলাম এক ভূত মাথায় চাপায়। বাবা মা মানা করেছিল, কিন্তু আংগুল ধরা হাতটা ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছা করে ইদানিং! পাখাটা যে একটু একটু বড় হচ্ছে! তো, কল সেন্টারে ইচ্ছা করে আমাকে মনে হয় পঁচা সময় ধরিয়ে দিয়েছে। ৩টা থেকে কল করা শুরু করেছি, কেউ বাসায় নেই। শুধু আনসারিং মেশিন। যে দু'একজন ছিল, ওরা রিটায়ারড বুড়োবুড়ি। হোম লোনের ব্যাপারে চাপাচাপি করতে হয়, আমি তো চাপাচাপি করতে পারি না, শুধু যা বলতে বলা হয়েছে, সেটা বলতেই বুড়ো ক্ষেপে গিয়েছে। 'আমি ৩০ বছর কষ্ট করে টাকা কামায় হোম লোন পে অফ করলাম আর তুমি আমাকে আরেকটা হোম লোন নিতে বলছো!' এক কি জ্বালা! ওই কল সেন্টারে অবশ্য উপমহাদেশের কেউ ছিল না। কেবল অ্যাংলো স্যাক্সন। সেটা হওয়ার সমস্যা হলো, ওরা কখনও মনে হয় মাইগ্র্যান্ট কারো সাথে কাজ করে নি। আমাকে যেভাবে ট্রিট করছিল মনে হচ্ছিল বাচ্চা মেয়ের সাথে কথা বলছে! ২ ঘন্টা পরেই ভীষণ বিরক্ত লেগে গেল। চলে আসলাম বলে। টাকাটা নিতেও ফিরে যাই নি!


কিছুদিনের মধ্যেই ভালো লেগে যাবে দেখেন আপু। আমি যখন প্রথম আসি, তখন স্কুলে কোন বাঙালি ছিল না। আমাকে যেই মেয়েরা প্রথমেই ডেকে নিজেদের কাছে বসালো ওরা শ্রীলংকান তামিল। আমাদের কালচারের সাথে তো তামিলদের অনেক তফাৎ, ভাষা হোক, খাবারের রুচি হোক, সব কিছুর সাথে ভারতীয়দের আরও অনেক মিল। তবু, ওই তামিল মেয়েগুলোর মাঝেই আস্তে আস্তে মনে হয় দেশ দেখতাম! ভৌগলিক দুরত্ব তো অন্তত: কম!


এক দিন রান্না করে কাজে সবাইকে খাইয়ে দিয়েন। দেখবেন কি করে সব পটে যায়!
Biplob Rahman said…
Bah! aito apur joro ta katche, ki shundar kore likhechen! Kazer modhdhe dub din plz, dekhben aro valo lagbe.

Ar ai lekhagulo shachle din na keno?

Onek valo thakben.
Anonymous said…
I always motivated by you, your thoughts and way of thinking, again, appreciate for this nice post.

- Norman

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন