বিন্দুর ছেলে


একটা সিনেমা দেখলাম একটু আগে। "বিন্দুর ছেলে"। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে মুশফিকুর রহমান গুলজারের পরিচালনা। অভিনয়ে- মৌসুমী, দিতি, হুমায়ূন ফরিদী, ফেরদৌস প্রমুখ। সিনেমা কেমন লাগলো, কার অভিনয় কেমন হলো, এসব গভীরতর চিত্র সমালোচনার উদ্দেশ্যে অবশ্য এই লেখা শুরু করি নি। উদ্দেশ্য বরং একেবারেই ভিন্ন। এই মুভি দেখে আমার ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেলো যে, তাই ।

আমার স্কুল- বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
আমরা তিন বোন। তিনজনই এই স্কুলেই পড়েছি। সবার বড় বোন যখন ক্লাস নাইন কি টেন, আমি তখন মাত্র ওয়ানে ভর্তি হলাম। তারও আগে মাঝে মাঝে আপুর সাথে এমনি এমনি যেতাম স্কুলে। বড় আপুর বান্ধবীরা সবাই ভীষন আদর করতো। সেই আদরের টানেই আমার আপুর সাথে যাওয়া।

বড় আপুর সময় স্কুলে মর্ণিং-ডে শিফট আলাদা ছিলো না। আপুদের ক্লাস শুরু হতো খুব সম্ভবত সকাল এগারোটার দিকে। আর শেষ হতো পাঁচটায়। টিফিন পিরিয়ডে ওরা খুবই মজা করতো। কয়েকটা আপুর কথা বেশি মনে পড়ে, বড় শম্পা আপু, ছোট শম্পা আপু, খনা আপু, লাবণ্য আপু, মণি আপু... এরকম আরো অনেকেই। ওরা টিফিন পিরিয়ডে নানা রকম শয়তানী করতো। টীচারদের নকল করা তো সব পোলাপানেরই কমন অভ্যাস, সেসব। তারপর বিভিন্ন কমেডি নাটক বানিয়ে অভিনয় করা, কৌতুক বলা...আবছাভাবে এইসবই মনে পড়ে। ক্লাস টেনকে আমার তখন খুব বিশেষ একটা কিছু মনে হতো। মনে হতো, ওরা কত বড়, কত স্মার্ট! আমি কবে ক্লাস টেনে উঠবো?!

আমার বড় আপুনির নাম শারমীন জাহান শাম্মী/শিমুল। এই স্ল্যাশ-এর রহস্য হচ্ছে, আম্মু ডাকতো শাম্মী আর বাবা ডাকতো শিমুল। পরে শাম্মীটাই চালু হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু বড় আপুর বেশি পছন্দ ছিলো শিমুল নামটাই। এটা হারিয়ে না যায় এজন্যে ও কোথাও নাম লিখলে এভাবে দুইটাই লিখতো। তো আমার এই আপুনীর গ্রুপের দুষ্টু এবং দুষ্টু মাত্রই অবধারিতভাবেই ট্যালেন্টেড মেয়েরা মিলে স্কুলের প্রোগ্রামে নাটক করবে ঠিক করলো। ওই সময় ওদের পড়ার তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎচন্দ্রই বেশি স্থান নিয়েছিলো বোধ করি। যদিও বড় আপু ব্যক্তিগতভাবে সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর ফেলুদা'র বিশেষ ভক্ত ছিলো। আর ওর পড়ার টেবিলে "ড্রাকুলা" নামের একটা বই থাকার ভয়ে ওই টেবিলের আশেপাশ দিয়েই যেতাম না মনে আছে। পড়তো "মাসুদ রানা"ও। কিন্তু নাটক বানানোর জন্য এগুলোর চাইতে চিরকালীন জনপ্রিয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেই ওরা বেছে নিয়েছিলো।

শরৎবাবুর "বিন্দুর ছেলে"ই কেন ওরা মঞ্চস্থ করবে বলে ঠিক করেছিলো তার কারন আমাকে না বললেও আন্দাজ করতে পারি। আমাদের স্কুলের নাম বিন্দুবাসিনী। আর এই গলের মূল চরিত্রের নামও বিন্দুবাসিনী। এই হয়তো কারণ। দু'টো প্রধান চরিত্র হচ্ছে "বিন্দু" এবং তার ভাসুরের বৌ। এই দু'টো চরিত্রের জন্য স্কুলের সবচেয়ে সেরা দুই সুন্দরী আপুকে নির্বাচিত করা হলো। এর মধ্যে বিন্দু হলো বড় শম্পা আপু এবং বড় বৌ হলো লুবনা আপু। এই দু'জনের মধ্যে বড় শম্পা আপু শুধু আমাদের স্কুলেই নয় বরং পুরো টাংগাইলের ছেলেদেরই হৃদয় কাঁপানো সুন্দরী ছিলেন, এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তখনকার সময়ে কাউকে বেশি সুন্দরী বুঝাতে হলে আমরা উদাহরণ দিতাম যে শ্রীদেবী'র মত সুন্দর! কিন্তু শম্পা আপু দেখতে আক্ষরিক অর্থেই শ্রীদেবীর মত ছিলেন। লুবনা আপুও অনেক সুন্দর ছিলেন।

তো এই দুই সুন্দরীকে দুই মূল ভূমিকায় রেখে তৈরি করা নাটকটা কেমন হয়েছিলো, কে কেমন করেছিলো বিশদ বলতে পারলে ভালো হতো নিশ্চয়ই কিন্তু দূর্ভাগ্য, স্মৃতি আর টানতে পারছে না। কিন্তু ভালো লাগার অনুভূতিটা স্পষ্ট মনে গেঁথে আছে। ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়ে দুই মা'য়ের দ্বন্দ দেখে সেই ছোট্ট আমার চোখে জল এসেছিলো তাও মনে পড়ে। তাই এতগুলো বছর পরে (কমপক্ষে ১৮/১৯ বছর) "বিন্দুর ছেলে" নিয়ে সিনেমা হয়েছে জেনে উৎসাহ নিয়ে দেখতে বসে গেলাম। সিনেমা ভালো-মন্দ যাই হোক (মন্দ নয়), আমার সেই ভীষন শৈশবকালকে একটুক্ষনের জন্য হলেও ফিরিয়ে নিয়ে এলো তো। এই বা কম কি?

Comments

Anonymous said…
khub sundor bolg apnar.
shondhabati said…
বিন্দুর ছেলে আমার পড়া প্রথম শরত। তাও কপিটা ছিল ক্ল্যাসিকেল। একই কপি নানাভাই পড়েছে, বড় খালামনি পড়েছে, মা পড়েছে, তারপর আমার হাতে এসেছে। ওটা পড়ে এত ভক্ত হয়ে গেলাম যে পুরা শরত রচনাসমগ্র বগলদাবা করলাম। তবে বিন্দুর ছেলে সিনেমাটা দেখতে ইচ্ছা করছে না। অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম শুনেই মনে হচ্ছে, দে কিলড ইট!
ছোটবেলা আমিও ভাইয়ার বন্ধুদের বড় ফ্যান ছিলাম। ক্লাস ফাইভ সিক্সের পুচকিগুলোকেও যেই হারে 'বড় আপু' 'বড় ভাইয়া' মনে হতো, এখন মনে পড়লে হাসি পায়!
সন্ধ্যা,

মজা লাগলো তোমার প্রাগৈতিহাসিক যুগের শরৎ রচনার বই হাতে পাবার কথা শুনে। শরৎ আমার তেমন পড়া হয় নি কেন যেন, সবার বলা সত্তেও কেন জানি তেমন উৎসাহ পাই নি কখনও। বেশ কিছু সিনেমা দেখেছি অবশ্য তাঁর কাহিনীর ওপরে।

"বিন্দুর ছেলে"র পাত্রপাত্রী নিয়ে যা বললে সে প্রসঙ্গে বলব যে, আমি ভাবছি না যে "দে কিলড ইট"। অথবা মেরে ফেললেও দায়ভার তাদের ওপরই নয়। আমার তো মনে হয় একটা মুভি সেন্ট পার্সেন্ট দায় পরিচালকের, ভালো হোক কি মন্দ। তুমি পশ্চিববাংলার ঋতুপর্ণ সেনগুপ্তকে চেন? বাংলাদেশের কিছু সিনেমায় কাজ করেছে সে মাঝে, অশ্লীলতার জন্য প্রায় বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলো! সেই একই অভিনেত্রী যখন ঋতুপর্ণ ঘোষের "দহন","উৎসব"; অপর্ণা সেনের "পারমিতার একদিন"-এ অভিনয় করেন, তখন আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়। কি বলবে এটাকে? আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের মৌসুমী ভালো অভিনয় করতে পারে, যদি তাকে কাজে লাগানো যায় ঠিকভাবে।

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন