"আগুনপাখি" পড়েছি বলে

এইমাত্র একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। উপন্যাস নয়, যেন পূর্ণ একটা জীবন-দেশ-ইতিহাসের দলিল। হাসান আজিজুল হক-এর "আগুনপাখি"। বইয়ের পাতা বন্ধ করে দেখি চোখে কেমন পানি আসতে গিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতরটা গুমড়ে উঠতে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠছে, ঠিক তারই মত। সে-- নাম কি তার? পুরো উপন্যাসে কোথাও কি তার নাম এসেছে একবারও? মনে পড়ছে না তো। কিন্তু সেই এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র, তার বয়ানেই সবটা বলা।

সেই বয়ান বড় সরল। ঠিক ঠান্ডা জলের মত শান্তিময়। কত কি ঘটে গেলো তার জীবনে।

আমি গ্রামে জন্মাইনি। মাঝে সাঝে হঠাৎ বেড়াতে যাওয়া ছাড়া গ্রামের কিছুই জানি না। "আগুনপাখি" পড়েছি বলেই এই গ্রাম্য সরল মহিলার বয়ানে গ্রামীন জীবন এবং তা দেশ-কাল অতিক্রম করে জীবন্ত হয়ে আজ আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন আমিই মাতৃহারা কৈশোরে ভাই কোলে নিয়ে পার করে দিতাম বেলা। তেমনি দিন পার করতে করতেই একদিন পা দিয়েছিলাম নতুন সংসারে। রূপকথায় শোনা "ফসলভরা ক্ষেত, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ" নিয়ে সমৃদ্ধ ছিলো সেই সংসার। মস্ত বড় বাড়ি, তেমনই বড় সংসার, স্বামী-সন্তান-শাশুড়ী-ননদ-দেওর-ভাসুর-জা আর রাখাল-মানিষ-মুহুরী নিয়ে ভরা। কোথাও কোন কমতি নেই। কত্তা বড় শক্ত-শীতল মানুষ, একা সামলে চলেন গোটা সংসার। তার কথার উপরে কেউ কোন কথা বলে না। সেই তুমুল সুখের জীবনেই হঠাৎ কোন দুনিয়ার যুদ্ধের ছায়াও লাগে। হঠাৎ পরনের কাপড়ে বড্ড কমতি পড়ে যায়। সেই সাথে স্বদেশী আন্দোলনে একাত্ব হয়ে মোটা কাপড় পরা শুরু হয়, একদিন সেই কাপড়ও আর যেন জোটে না। সূতা-রং আর অন্যান্য কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় দেশী তাঁত। এর মাঝে "ওলাবিবি" আর "মা-শেতলা"ও ছাড়ে না...গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে তারা কলেরা আর বসন্তে নিঃশেষ করে দিয়ে যায় গ্রামকে গ্রাম। প্রকৃতিই বা ছাড়বে কেন? পরপর দু'বছর ফসল হয় না--একবার খরায়, একবার অতি বর্ষনে। হায় আকাল। তবু এই করেই দিন যায়। দুঃখ-কষ্টে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায় সেই বিশাল সংসার, সবাই আলাদা, যার যার মত। আকাল কাটে, আসে নতুন দুর্দিন। দেশে স্বাধীনতার আন্দোলনের মাঝে কে যেন রব তোলে মোসলমানের আলাদা দেশের দাবি তুলে। শুরু এক সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধ, হিন্দু-মোসলমানের যুদ্ধ। দিকে দিকে হিন্দু আর মোসলমান একে অপরকে মেরে কেটে এতদিনের সহাবস্থান সব ভুলে যায়, ভারতবর্ষ স্বাধীন করে দেবার আগে ব্রিটিশদের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়। আসে স্বাধীনতা, আর ভেঙে টুকরো টুকরো হয় ভারতবর্ষ।

এই আমার শেকড়, আমার ইতিহাস।

এই মহিলা, যিনি আজীবন মুখ বুজে কেবল পিতা বা স্বামী বা শাশুড়ীর আদেশই পালন করে গেলেন। নিজের কোন অভিমত কোন বিষয়ে দিতে গেলেন না এবং তা হাসিমুখেই, সেই একই মানুষ তার সমস্ত জীবনের সবটুকু অভিজ্ঞতা নিয়েই সবার বিপরীতে, সবার অমতে আঁকড়ে রইলেন তার দেশের মাটি।

দেশভাগের পরে সবাই যখন আলাদা হয়ে যাওয়া মোসলমান দেশ পাকিস্তানে যেতে শুরু করলো, তখন নিজের দেশে বসে থেকে তিনি ভাবেন--

"আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে।"

হায়, হিন্দুরাষ্ট্র আর মুসলমানরাষ্ট্র তত্ত্বর অসাড়তা, অবাস্তবতা এবং অকার্যকরিতা ভারতবর্ষর হাজারো সাধারণ মানুষ মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করলেও, করে নি দেশের হর্তা কর্তারা।

ইতিহাস, কিন্তু তথ্য-তত্ত্বর খটখটে বিবরণ নয়, অতি সাধারণ গ্রাম্য এক মহিলার জীবনের ছবি এঁকে, তারই মুখে সেই জীবনের কাহিনী বর্ণনা করে যেভাবে এখন থেকে অনেক কাল আগের সেই সময়ে লেখক নিয়ে যেতে পেরেছেন পাঠককে, এর চেয়ে সহজে আর কি করে ততটা বাস্তব উপলদ্ধির জন্ম দেয়া যেত আমার জানা নেই। "আগুনপাখি" হাসান আজিজুল হক-এর প্রথম এবং এ পর্যন্ত একমাত্র উপন্যাস। ১৯৬০ সাল থেকে লেখালেখি করে এতটা স্বনামধন্য হবার পরেও কেন এতদিন কোন উপন্যাস লিখেন নি, এই প্রশ্নের মুখে "আগুনপাখি" একটি যথার্থ উত্তর। এরকম একটি উপন্যাস সারা জীবনে একটি লিখতে পারলে বোধহয় লেখক জীবনে আরও খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না।

Comments

Imam Alam said…
তোমার কোন একটা বড় সমস্যা আস্যে আমি ঠিক ধরতে পারতেস্যি না কোথায়।

এগুলো অনেক আগেকার কথা। ব্যাপার এটা না যে আগেরটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন অর্থ হয় না। অবশ্যই হয়। কিন্তু তুমি কি কখনো ভাবো এখন ঠিক কি কি হচ্ছে যেগুলো আমাদের চোখের সামনেই হচ্ছে কিন্তু কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা ধরতে পারতেস্যি না?

আমার প্রিয় কমেডিয়ান (তুমি চেনো, টিভিতে দেখায় একটা সিরীয, হাউস, ওটার প্রটাগনিস্টের ক্যারেক্টারটা করে) হিউ লঊরি ঠিক কেন আমার প্রিয় কমেডিয়ান সেটা আমি জানি না। তবে এটা দেখো।
http://au.youtube.com/watch?v=_SjBdVYG9ms
This comment has been removed by the author.
ভুল করে না থাকলে এই ইমাম আলম'টা বোধ হয় উচ্ছ্বাস, নাকি?

কিছু খেয়েছো নাকি? কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হচ্ছে।

পড়ার অভ্যাসটা এখনও আছে তো? একটা বই পড়ে শেষ করবার পরে অনুভূতি কোথায় ঘোরাফেরা করে জানো তো? এই লেখাটার ক্যাটাগরী "সাহিত্যপাঠ", লেখাটা পড়ে থাকলে ক্যাটাগরীও দেখেছো আশা করি।

এইটুকু বলেই থামতাম। তাও ভাবলাম বন্ধু মানুষ, প্রশ্ন করেছো, উত্তর দেই... "ক" করলে "খ" যাবে না এরকম কোন দিব্যি আমি কাটি নি। বুঝা গেলো?

আমার ব্লগে আসছো, ধন্যবাদ। ফিজিক্সের গবেষনার মধ্যে "আমার কোন একটা বড় সমস্যা"ও জায়গা পেয়ে গেলো, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং!
toxoid_toxaemia said…
আপু, আপনার লেখাটা পড়বার পরে উপন্যাসটা পড়তে ইচ্ছে করছে খুব। এটার নাম শুনলেও কখনোই পড়া হয়ে ওঠেনি। সাহিত্যপাঠের বর্ণনাটা ভাল হয়েছে। আমার কাছে একদমই কোনও অসংলগ্নতা চোখে পড়েনি।
Imam Alam said…
প্রথম কথা, না আমি ওরকম কিস্যু খাইনা।
তারপর, আবার পড়ে দেখলাম, না অসংলগ্ন লাগতেস্যে না নিজের কথাগুলা।

হু দেখেছি। কিছু একটা পড়ার পর কি হয় জানি। একটু ঘোর আসে।

আমি বলতে চাচ্ছিলাম, অন দ্য লং রান, বর্তমানটা মানুষের কাছে প্রাধান্য পায় কম। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

কিন্তু তোমার বোঝানোর স্টাইলটা জটিল... হিহিহি।
Ahmed Arif said…
"আগুনপাখি" পড়ি নাই। তোমার লেখা পড়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কত অসাধারণ লেখা যে না পড়া থেকে গেলো। আফসোস হয়।

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন