জুবায়ের ভাই...সুখে থেকো ভালো থেকো
যে মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসেছি তাকে নিয়েই লিখব ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু বিষয়বস্তুটা যে এমন করে বদলে যাবে, কিছুতেই তো বুঝতে পারি নি আগে। এখনও কি বুঝছি? বিশ্বাস করতে পারছি? না জুবায়ের ভাই, তিনটা বিষন্ন দিন পার করে এখনও বিস্ময়ে ভাবছি, সত্যি চলে গেলেন এতটা দূরে?
গত তিনটা দিন অসংখ্যবার একটা কিছু লিখব ভেবে শিউরে উঠে দূরে সরে গিয়েছি...এও কি হয়? এই ভীষন প্রাণবন্ত জীবন্ত মানুষটাকে নিয়ে কি করে এমন শোকগাঁথা লিখা যায়? কেন লিখতে হয়? গত মাসে সচলায়তনে তার অসুস্থতার খবর পড়ে আঁতকে উঠেছিলাম, এত প্রিয় মানুষটা এত কষ্ট পাচ্ছে এই ভেবেই কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু ভীষন বিশ্বাস ছিলো, বেশিদিনের জন্য নয়, জুবায়ের ভাই সুস্থ হয়ে উঠবেন অতি শিঘ্রী। এসেই আনন্দমাখা একটা পোস্ট দেবেন। আমরা সবাই ঝাপিয়ে পড়ে সেই পোস্টে মন্তব্য করে, পাঁচ তারা দিয়ে তাকে স্বাগত জানাবো আর খুব করে বকে দেব মাঝের কয়েকটা দিন আমাদের এরকম দুশ্চিন্তায় রাখার জন্য। সচলায়তনে আমার পরবর্তী পোস্ট হবে জুবায়ের ভাইয়ের সুস্থতা উপলক্ষ্যে আনন্দপোস্ট, কি লিখব সেইসব ভাষাও ঠিক করে রেখেছিলাম। একটা মুহুর্তের জন্যও কি এই ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবেছিলাম?
আজকে লিখতে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। এই মানুষটা বয়সে আর সবার চাইতে অনেকটা বড় হয়ে কখনও দাদাগিরি ফলালেন না, অনেক বেশি অভিজ্ঞ লেখক হয়েও কখনও আমাদের শিক্ষানবিস বলে ছোট করে দেখলেন না, আমাদের পাশে ঠিক চিরতারুণ্য ধরে রেখে প্রিয় বন্ধুর মত বলে গেলেন নিজের কথা। দেখালেন তার বাতিঘরের আলো।
জুবায়ের ভাইয়ের লেখা আমি প্রথম পড়ি সামহোয়ারইন ব্লগে, তার উপন্যাস "পৌরুষ"। প্রতিদিনই দেখতাম একজন নতুন ব্লগার (তখনও জানি না কতদিনের লেখক তিনি) ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসের একেকটি পর্ব পোস্ট করতেন। আমি খুব অবাকই হয়েছিলাম, ওই ব্লগের ওই পরিবেশে উপন্যাস পোস্ট করার সাহস দেখে। পড়ব পড়ব করে পড়া হচ্ছিলো না। একদিন প্রিয় বন্ধু আনোয়ার সাদাত শিমুল বললেন উপন্যাসটি পড়া শুরু করতে। শিমুলকে ধন্যবাদ সেই থেকেই আমার জুবায়ের ভাইয়ের লেখা এবং তার সাথে পরিচয়। আমি যখন উপন্যাসটি পড়তে শুরু করি ঠিক সেইদিনই তিনি শেষ পর্বটি পোস্ট করেছিলেন। "প্রজাপতি" নামে ওখানে আমি ব্লগিং করতাম। আমি মন্তব্য করার পরে বললেন,
প্রজাপতি, শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। :-) আজ এই একটু আগে এই লেখার শেষ কিস্তি পোস্ট করেছি। কাকতালীয় হোক বা ইচ্ছাকৃত, বিলম্বে ক্ষতি কিছু হয়নি। শামিল হওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।
আমার কেমন মনে হলো, যেন খানিক মন খারাপ হয়েছে কেউ এত দেরিতে পড়া শুরু করেছে বলে। যদিও ব্যাপারটা মোটেও সেরকম ছিলো না, তিনি তো আর আমার মত ছেলেমানুষ ছিলেন না! এই কথোপকথনগুলো খুব মনে পড়ছে, আর তো কথা হবে না কখনও, এইটুকুই নিজের কাছে এনে রাখি।
প্রজাপতি: জুবায়ের ভাই, পড়ছি কিন্তু। প্রথম পর্বে বলেছি বিশ্বাস করেন নি ঠিকমতো। এই যে একটু করে চিহ্ন রেখে গেলাম। আজকে টানা অনেকটা পড়ব। এবং পড়তে ভালো লাগছে। তার'চে বড় কথা, আগ্রহ বোধ করছি সামনে এগুনোর।
মুহম্মদ জুবায়ের: প্রজাপতি, একটু ভুল বুঝেছেন। আপনি পড়ছেন সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিনি। আমার লেখা সম্পর্কে প্রশংসামূলক কথা শুনেছেন জেনে বলেছিলাম শোনা কথা বিশ্বাস না করতে। অর্থাৎ পড়ার জন্যে আপনাকে পরোক্ষে তাগিদ দেওয়া আর কি! :-)
এরপর প্রতিটা পর্বেই আমি যে পড়েছি সেই চিহ্ন রাখার একটা ছেলেমানুষী শুরু করলাম। জানি না সেইজন্যই কিনা জুবায়ের ভাই আমাকে মনে রাখলেন। সচলায়তনের একদম শুরুর দিকে আমার জন্মদিনের তারিখ পড়লো। জন্মদিনের পোস্টে কারও মন্তব্য পেলে খুবই ভালো লাগে কিন্তু কেউ শুভেচ্ছা না জানালে তো দোষের কিছু নেই। তবু জুবায়ের ভাইকে ঝাড়ি দিলাম আমাকে শুভেচ্ছা না জানানোর জন্য। তিনি খুবই দুঃখিত হয়ে বললেন, "কেমনে বুঝব যে নিঘাত তিথিই ওই বাড়ির প্রজাপতি?" তারপরে ওই পোস্টে গিয়ে বললেন,
মুহম্মদ জুবায়ের | শুক্র, ২০০৭-০৬-১৫ ০২:৪১
মুহম্মদ জুবায়ের | বুধ, ২০০৮-০৪-০২ ১৪:১৩
সেই সমস্ত স্মৃতিগুলোই ঘুরেফিরে বারবার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। হতভম্ব হয়ে বুঝার চেষ্টা করছি, তার লেখা গল্প, উপন্যাস, ব্লগ, দেশচিন্তা, তার বাতিঘরের আলো এবং বন্ধুর ও অভিভাবকের মত সমালোচনা বা আলোচনা সব কিছু থেকে কি আশ্চর্য অলীক দ্রুততায় এবং অকস্মাৎ আমরা বঞ্চিত হয়ে গেলাম!
এই সমস্ত কথা এবং আরো অনেক অনেক কথাই এখন আমাদের হৃদয়জুড়ে। যতটা কথা, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার। জানি না আমাদের প্রিয় জুবায়ের ভাই কোথায়, কেমন করে আছেন। আমরা রয়ে গেছি এখনও এইখানেই, তার অস্তিত্ব বুকে ধারণ করে। প্রিয় জুবায়ের ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। শান্তিতে থাকুন।
আমরা আপনাকে কখনও ভুলব না।
গত তিনটা দিন অসংখ্যবার একটা কিছু লিখব ভেবে শিউরে উঠে দূরে সরে গিয়েছি...এও কি হয়? এই ভীষন প্রাণবন্ত জীবন্ত মানুষটাকে নিয়ে কি করে এমন শোকগাঁথা লিখা যায়? কেন লিখতে হয়? গত মাসে সচলায়তনে তার অসুস্থতার খবর পড়ে আঁতকে উঠেছিলাম, এত প্রিয় মানুষটা এত কষ্ট পাচ্ছে এই ভেবেই কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু ভীষন বিশ্বাস ছিলো, বেশিদিনের জন্য নয়, জুবায়ের ভাই সুস্থ হয়ে উঠবেন অতি শিঘ্রী। এসেই আনন্দমাখা একটা পোস্ট দেবেন। আমরা সবাই ঝাপিয়ে পড়ে সেই পোস্টে মন্তব্য করে, পাঁচ তারা দিয়ে তাকে স্বাগত জানাবো আর খুব করে বকে দেব মাঝের কয়েকটা দিন আমাদের এরকম দুশ্চিন্তায় রাখার জন্য। সচলায়তনে আমার পরবর্তী পোস্ট হবে জুবায়ের ভাইয়ের সুস্থতা উপলক্ষ্যে আনন্দপোস্ট, কি লিখব সেইসব ভাষাও ঠিক করে রেখেছিলাম। একটা মুহুর্তের জন্যও কি এই ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবেছিলাম?
আজকে লিখতে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। এই মানুষটা বয়সে আর সবার চাইতে অনেকটা বড় হয়ে কখনও দাদাগিরি ফলালেন না, অনেক বেশি অভিজ্ঞ লেখক হয়েও কখনও আমাদের শিক্ষানবিস বলে ছোট করে দেখলেন না, আমাদের পাশে ঠিক চিরতারুণ্য ধরে রেখে প্রিয় বন্ধুর মত বলে গেলেন নিজের কথা। দেখালেন তার বাতিঘরের আলো।
জুবায়ের ভাইয়ের লেখা আমি প্রথম পড়ি সামহোয়ারইন ব্লগে, তার উপন্যাস "পৌরুষ"। প্রতিদিনই দেখতাম একজন নতুন ব্লগার (তখনও জানি না কতদিনের লেখক তিনি) ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসের একেকটি পর্ব পোস্ট করতেন। আমি খুব অবাকই হয়েছিলাম, ওই ব্লগের ওই পরিবেশে উপন্যাস পোস্ট করার সাহস দেখে। পড়ব পড়ব করে পড়া হচ্ছিলো না। একদিন প্রিয় বন্ধু আনোয়ার সাদাত শিমুল বললেন উপন্যাসটি পড়া শুরু করতে। শিমুলকে ধন্যবাদ সেই থেকেই আমার জুবায়ের ভাইয়ের লেখা এবং তার সাথে পরিচয়। আমি যখন উপন্যাসটি পড়তে শুরু করি ঠিক সেইদিনই তিনি শেষ পর্বটি পোস্ট করেছিলেন। "প্রজাপতি" নামে ওখানে আমি ব্লগিং করতাম। আমি মন্তব্য করার পরে বললেন,
প্রজাপতি, শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। :-) আজ এই একটু আগে এই লেখার শেষ কিস্তি পোস্ট করেছি। কাকতালীয় হোক বা ইচ্ছাকৃত, বিলম্বে ক্ষতি কিছু হয়নি। শামিল হওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।
আমার কেমন মনে হলো, যেন খানিক মন খারাপ হয়েছে কেউ এত দেরিতে পড়া শুরু করেছে বলে। যদিও ব্যাপারটা মোটেও সেরকম ছিলো না, তিনি তো আর আমার মত ছেলেমানুষ ছিলেন না! এই কথোপকথনগুলো খুব মনে পড়ছে, আর তো কথা হবে না কখনও, এইটুকুই নিজের কাছে এনে রাখি।
প্রজাপতি: জুবায়ের ভাই, পড়ছি কিন্তু। প্রথম পর্বে বলেছি বিশ্বাস করেন নি ঠিকমতো। এই যে একটু করে চিহ্ন রেখে গেলাম। আজকে টানা অনেকটা পড়ব। এবং পড়তে ভালো লাগছে। তার'চে বড় কথা, আগ্রহ বোধ করছি সামনে এগুনোর।
মুহম্মদ জুবায়ের: প্রজাপতি, একটু ভুল বুঝেছেন। আপনি পড়ছেন সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিনি। আমার লেখা সম্পর্কে প্রশংসামূলক কথা শুনেছেন জেনে বলেছিলাম শোনা কথা বিশ্বাস না করতে। অর্থাৎ পড়ার জন্যে আপনাকে পরোক্ষে তাগিদ দেওয়া আর কি! :-)
এরপর প্রতিটা পর্বেই আমি যে পড়েছি সেই চিহ্ন রাখার একটা ছেলেমানুষী শুরু করলাম। জানি না সেইজন্যই কিনা জুবায়ের ভাই আমাকে মনে রাখলেন। সচলায়তনের একদম শুরুর দিকে আমার জন্মদিনের তারিখ পড়লো। জন্মদিনের পোস্টে কারও মন্তব্য পেলে খুবই ভালো লাগে কিন্তু কেউ শুভেচ্ছা না জানালে তো দোষের কিছু নেই। তবু জুবায়ের ভাইকে ঝাড়ি দিলাম আমাকে শুভেচ্ছা না জানানোর জন্য। তিনি খুবই দুঃখিত হয়ে বললেন, "কেমনে বুঝব যে নিঘাত তিথিই ওই বাড়ির প্রজাপতি?" তারপরে ওই পোস্টে গিয়ে বললেন,
মুহম্মদ জুবায়ের | শুক্র, ২০০৭-০৬-১৫ ০২:৪১
দেরি হইছে তো কী হইছে? এখন চিল্লাইয়া কই, শুভ জন্মদিন।
কেউ বলবে এই মানুষটার মধ্যে সিনিয়র লেখকসুলভ কোন অহংকার আছে? আমার মত এরকম অনেককেই ক্রমাগত মন্তব্য দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। বন্ধু হয়ে থেকেছেন। মন্তব্য-প্রতি মন্তব্যে কত মজা করা, দুঃখ ভাগ করে নেয়া...। দেশের বাইরে আসার পর আমি ক্রমাগতই দেশ নিয়ে মন খারাপ করা পোস্ট দিয়ে গিয়েছি সচলায়তনে। একবার সেরকম এক পোস্টে নিজের প্রতি কেমন জেদ নিয়ে লিখলেন,মুহম্মদ জুবায়ের | বুধ, ২০০৮-০৪-০২ ১৪:১৩
আমরা সবাই দেশের কথা ভেবে, আপনজনদের কথা ভেবে বিষাদাক্রান্ত হবো, চলে যাবো বলে সংকল্প করবো। কিন্তু সেই সংকল্প ভুলে যাবো পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের আর যাওয়া হয়ে উঠবে না। যাবো-যাচ্ছির বিলাসিতাই সার। কাউকে ছোটো করার জন্যে বলছি না, এটা আমার নিজের কথা বলা। নিজেকে ধিক্কার দেওয়া। বাইশ বছর হয়ে গেলো ....
সেই সমস্ত স্মৃতিগুলোই ঘুরেফিরে বারবার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। হতভম্ব হয়ে বুঝার চেষ্টা করছি, তার লেখা গল্প, উপন্যাস, ব্লগ, দেশচিন্তা, তার বাতিঘরের আলো এবং বন্ধুর ও অভিভাবকের মত সমালোচনা বা আলোচনা সব কিছু থেকে কি আশ্চর্য অলীক দ্রুততায় এবং অকস্মাৎ আমরা বঞ্চিত হয়ে গেলাম!
এই সমস্ত কথা এবং আরো অনেক অনেক কথাই এখন আমাদের হৃদয়জুড়ে। যতটা কথা, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার। জানি না আমাদের প্রিয় জুবায়ের ভাই কোথায়, কেমন করে আছেন। আমরা রয়ে গেছি এখনও এইখানেই, তার অস্তিত্ব বুকে ধারণ করে। প্রিয় জুবায়ের ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। শান্তিতে থাকুন।
আমরা আপনাকে কখনও ভুলব না।
Comments
শুধু বলি, মানুষ কোথায় যায়?