আমার দেখা বাংলা সিনেমা (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক)

হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ হবার পরে টিভিই রইলো একমাত্র সম্বল। একটু বুদ্ধি হবার পর থেকেই যে সিনেমাটি টিভিতে সবচেয়ে বেশি দেখেছি তা"জীবন থেকে নেয়া"। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী-- যেকোন দেশাত্ববোধক উপলক্ষে এই একটি সিনেমাই দেখানো হতো। সম্ভবত রাজনৈতিক জটিলতায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য যেকোন সিনেমা দেখানোটা ওই সময়ের সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিলো না (হায়!)। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সিনেমাটি যতবারই দেখেছি, নতুন করে ভালো লেগেছে। ছোটবেলায় এই সিনেমার রূপক অর্থটি বুঝিনি, তবুও ভীষন উপভোগ্য মনে হতো। খান আতার সেই চিরদিনের অসম্পূর্ণ গান, " এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?" কখনোই ভোলার নয়। এবং সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, "ঘরে ঘরে দূর্গ গড়তে হবে"...অসাধারণ। একটু বড় হয়ে, একটু বুঝার পর থেকেই কেবল ভাবি, কি পরিমাণ মেধা থাকলে একজন পরিচালক এরকম একটি সিনেমা তৈরি করতে পারেন। কি অসাধারণ প্লট, কি পারফেক্ট রূপক- একটি পরিবারের মধ্য দিয়ে পুরো একটি দেশের সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটি তুলে ধরা, সর্বোপরি প্রতিটি পাত্র-পাত্রীর চমৎকার অভিনয়। দেখতে দেখতে মুখস্ত হয়ে যাওয়া এই সিনেমাটি তাই তুমুল উৎসাহ নিয়ে এখনও আবার দেখতে বসি। এই রকম পারফেক্ট সিনেমা বাংলাদেশের চ্চলচিত্র জগতে বোধহয় বিরল। তাই প্রিয় সিনেমা কোনটা কখনো ভাবতে চোখ বন্ধ করে আগে বলে নেই, "জীবন থেকে নেয়া"। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় জহির রায়হানের উদ্দেশ্যে আরেকবার হ্যাটস অফ।

ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধের আর যে সিনেমাটি অনেকবার দেখেছি তা হলো, "আলোর মিছিল", পরিচালনায় মিতা। অভিনেতা অভিনেত্রী মূলত ছিলেন ববিতা-রাজ্জাক, মামা-ভাগ্নি চরিত্রে। আর ছিলেন ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী আফসারী। মূলত মুক্তিযুদ্ধের পরের পটভূমি নিয়ে তৈরি এই ছবিতে অসাধারণ একটি গান ছিলো সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া, "এই পৃথিবীর পরে, কত ফুল ফোটে আর ঝরে/ সে কথা কি কোন দিন, কখনও কারো মনে পড়ে"। এই গানে ফুটফুটে ববিতার চমৎকার হাসির কথা মনে পড়ে। আরেকটি গান, "দুঃখ করো না বন্ধু তোমরা যদি না পারি/ আগেকার সেই সুরে সুরে গাইতে আমার গান/ প্রশ্ন করো না হৃদয়জুড়ে এ কোন অভিমান?"

মুক্তিযুদ্ধের আর কোন সিনেমা বিটিভিতে সেই সময় দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। এরপর টানা অনেকগুলো বছর পরে বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো '৯৬তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পরে। তখনই দেখেছিলাম সুভাষ দত্তর "অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (ববিতা)", খান আতার "আবার তোরা মানুষ হ", আলমগীর কবীরের "ধীরে বহে মেঘনা", চাষী নজরুল ইসলামের "ওরা এগারো জন" এই সিনেমাগুলো। '৯৬ আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, একটা একটা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখতাম, আর শিউড়ে উঠতাম- কখনও কষ্ট, কখনও আনন্দে। অসাধারণ সব দেশাত্ববোধ সব গান ছিলো এই সবগুলো ছবিতে, " এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা", "এক নদী রক্ত পেরিয়ে", "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি", "কত যে ধীরে বহে মেঘনা"। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমাটি যতদূর জানি ওপার বাংলার সহায়তায় মির্মিত একটি ছবি, কেন যে নাম মনে করতে পারছি না! ওপারের বিশ্বজিৎ ছিলেন অভিনয়ে। লতা মুঙ্গেরশকরের কণ্ঠে চমৎকার একটি গান ছিলো সেই ছবিতে, " ও দাদাভাই, দাদাভাই মূর্তি বানাও/ নাক-মুখ-চোখ সবই বানাও/ হাত বানাও, পা-ও বানাও/ বুদ্ধ-যীশু সবই বানাও/ মন বানাতে পারো কি? একটা ছোট?/ বোন বানাতে পারো কি?/ দাদাভাই বোন বানাতে পারো কি?"

এরপর অনেক বছর পরে সম্ভবত ১৯৯৫তে হুমায়ূন আহমেদ আবার বানালেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি, "আগুনের পরশমণি"। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা শহর, ঢাকায় থাকা একটি পরিবারের বন্দি-জীবন, সেই পরিবারে হঠাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব- এই নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কাহিনী। আমার কাছে ভীষন হৃদয়ছোঁয়া মনে হয়েছিলো। বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, ডলি জহুর, আবুল হায়াত, শিলা আহমেদ- নাটকের এই মানুষগুলো তাদের অভিনয়ক্ষমতায় আরো মহিমান্বিত করেছিলেন এই সিনেমাটিকে। এই সিনেমাটিও আমি টিভিতেই দেখেছিলাম, হলে নয়। আবার দীর্ঘবিরতির পরে ২০০৭ সালে দেখলাম তৌকির আহমদের "জয়যাত্রা", আন্তর্জাতিক চ্চলচিত্র উৎসবে, জাতীয় জাদুঘরে। এবং একই সময়ে দেখলাম টিভিতে মুক্তি পাওয়া হুমায়ূন আহমেদের "শ্যামল ছায়া"। এই দু'টো সিনেমার পটভূমি আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় একই। তবু ভালো লাগলো দু'টোই।

মূলধারার সিনেমার বাইরে একটি সিনেমার কথা বলতে হবে, তারেক মাসুদের পরিচালনা, ক্যাথরিন মাসুদের প্রযোজনায় "মুক্তির গান"। টিভিতেই দেখেছিলাম। এবং মুক্তিযুদ্ধের সমরকার এরকম একটি প্রামাণ্যদলিল দেখে গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। একটি দৃশ্যের কথা মনে আছে, এখনও লিখতে গিয়ে চোখে পানি আসছে-- ভারতে যাবার আগে তারেক মাসুদ বাংলাদেশ সীমান্তের এক মুঠো নরম কাদা হাতে তুলে নেন। ওই মুহুর্তে হৃদয়ের গভীর থেকে উপলদ্ধি করি "আমার দেশের মাটি/ খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি"। এই সিনেমাতেই প্রথম শুনি মৌসুমি ভৌমিকের কণ্ঠে মর্মস্পর্শী "যশোর রোড" গানটি। তারেক মাসুদের আরেকটি সিনেমা "মাটির ময়না"। এটিও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প নিয়েই, যদিও এতে প্রাধাণ্য পেয়েছিলো মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রের ভুবন। এই চমৎকার সিনেমাটি দেখেছিলাম বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে।

এখন অপেক্ষা করে আছি, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে আরো অনেক ভালো ছবি দেখব বলে।
(চলবে)

Comments

Anonymous said…
আসলেই অদ্ভুত সুন্দর কিছু সিনেমা।

দু'ধারে বসত মোরা ঈশ্বরের কাছে--
নালিশ জানাবো।
Anonymous said…
আপু,নতুন লেখা কই??

ইদানীং খুব বিজি নাকি??

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন