আমার দেখা বাংলা সিনেমা
ছোটবেলায় ব্যাপারটা ছিলো ঠিক উল্টো। মানে এখন যেমন নাক প্রায় সিঁটকিয়েই বাংলা সিনেমার বড়জোর খবর নেই, ছোটবেলায় বরং প্রবল আকর্ষন ছিলো সিনেমা ব্যাপারটার প্রতি। আর সিনেমা মানেই বাংলা সিনেমা। বিটিভিতে ইংরেজী সিনেমা দেখাতো বটে কিন্তু সেটাকে সিনেমা না ভেবে "মুভি অব দ্য উইক" ভাবাটাই বেশি যৌক্তিক মনে হত সেই সময়!
অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের বাসায় সাদাকালো টিভি ছিলো। তখন টিভিতে দেখানোও হতো বেশিরভাগ সাদাকালো ছবিই। নায়ক-নায়িকা হয় রাজ্জাক-কবরী-ববিতা নয়ত শাবানা-আলমগীর, কখনও শবনম-রহমান। এর বেশি নিজের মনে নেই, তবে আমার মায়ের খুব পছন্দের ছিলো নায়িকা ছিলো সুজাতা। এক্কেবারে পিচ্চীবেলার সিনেমাগুলো বিটিভিতে দেখাতো বৃহস্পতিবার রাত আটটার সংবাদের পরে। আমরা সবাই সার বেঁধে ড্রইং রুমে বসে যেতাম। দেড় ঘন্টা দেখার পরেই ইংরেজী সংবাদ, মানে আধ ঘন্টার বিরতি। সেই সময়েই ঘটতো করুণ ঘটনা। আমার বাবা আমাকে নানান ভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করত। একেক দিন একেক অজুহাত, "মা, আজকে তো আর দেখাবে না, পরের অংশের ফিতা নষ্ট হয়ে গেছে", অথবা "আরে এইটা শুক্রবারে সকালে আবার দেখাবে তখন দেখো" ইত্যাদি নানা অজুহাত। সেই সব স্বপ্নময় সাদাকালো সিনেমাগুলো আমার কখনই তাই দেড় ঘন্টার বেশি দেখা হয় নি।
তার বেশ কিছুদিন পরে বোধহয় শুক্রবারে সিনেমা দেখানো শুরু হলো। মাসে এক শুক্রবারে বাংলা সিনেমা, বাকি শুক্রবারগুলোতে "মুভি অব দ্য উইক"। ওই এক শুক্রবারের জন্য হা করে বসে থাকতাম। তখন কিছু কিছু রঙীন সিনেমা দেখানো শুরু হলো, কিন্তু আমাদের তো সেই সাদাকালো টিভিই। একটু মন খারাপ হতো, কিন্তু কিছু বলতাম না। কিন্তু যেদিনই আবার সাদাকালো সিনেমা হতো, সেদিনই খুশিমনে বলে উঠতাম, " খুব ভালো হইসে, যাদের বাসায় রঙীন টিভি, আজকে তারাও সাদাকালো দেখবে"!
হলে গিয়েও সিনেমা দেখেছি, প্রথম কোনটা মনে পড়ছে না। তবে অনেক ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম "ভেজা চোখ"। ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা , মিঠুন, শিশুশিল্পী জয়া আর মনে হয় দিতি নাকি নিপা মোনালিসা নিশ্চিত নই। চমৎকার সব গান ছিলো। "জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প", "তুই তো কাল চলে যাবি আমাকে ছেড়ে/পরশু কি হবে দেখা এমন করে","প্রিয়া আমার প্রিয়া","পেয়েছি চাচী পেয়েছি ও চাচা" এইগুলো মনে পড়ছে। সিনেমা দেখে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে ফেলেছিলাম। পত্রিকার একটা রিপোর্টের শিরোনামও মনে আছে হুবুহু, "ভেজা চোখ দর্শকদের চোখ ভিজিয়েছে"। এখন দেখলে কেমন লাগবে জানি না কিন্তু তখন অসাধারণ লেগেছিলো। চম্পা বোধহয় নতুন এলেন তখন সিনেমায়, আমার কাছে চম্পা-ইলিয়াস কাঞ্চনকে খুবই স্মার্ট লাগতো তখন। :)
প্রায় সমসাময়িক কালে আরো দুইটা সিনেমার কথা মনে পড়ে যেগুলো হলে গিয়ে দেখেছিলাম। মফস্বল শহরের ছোট্ট গন্ডির মজা হচ্ছে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। আর এর মাঝেও যারা কোন কারনে কাছাকাছি থাকে, তাদের আত্মীয়তা বেড়ে যায় আরো অনেক বেশি। আমার বাবা ব্যাংকার। বাবার কলিগদের এবং তাদের পরিবারের মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। এই সব কলিগ-পরিবারের একটা গেট টুগেদারের একটা অংশ ছিলো সিনেমা দেখা। হলের দোতলায় আলাদা একটা রুম ছিলো, কি জানি বলতো ওইটাকে, ডিসিই কিনা? ওই রুমটা রিজার্ভ করে আমরা অনেকগুলো পিচ্চী-পাচ্চী এবং আমাদের বাবা-মায়েরা মিলে দেখতে গেলাম ওই সময়ের মহা-হিট সিনেমা "দুই জীবন"। আফজাল-দিতি, বুলবুল আহমেদ-কবরীর অভিনয়, আবদুল্লাহ-আল-মামুনের পরিচালনা। মজার সিনেমা। আমাদের সব পোলাপানেরই খুব পছন্দ হয়েছিলো। এই সিনেমারও চমৎকার সব গান ছিলো, "তুমি আজ কথা দিয়েছো, বলেছো", "একদিন তোমায় আমি না দেখিলে, তোমার মুখের কথা না শুনিলে","তুমি ছাড়া আমি একা, পৃথিবীটা মেঘে ঢাকা","আবার দু'জনে দেখা হলো, কথা হলো","আব্বু আমার বন্ধু, আম্মু খেলার সাথী, একটি ঘরে জ্বলছে যেন তিনটি সুখের বাতি"...। শেষের এই গানটা মোটামুটি আমার জাতীয়সংগীত হয়ে গিয়েছিলো।
এই সিনেমা দেখার সময় বড়দের আলাপে শুনলাম আফজালের সংগে পাল্লা দিয়ে সুবর্ণা মুস্তফাও একই সময়ে আরেকটি সিনেমা করেছেন, নাম "স্ত্রী"। আম্মু, চাচীরা "স্ত্রী" সিনেমাটি দেখতে খুবই উদগ্রীব হয়ে উঠলেন, অতএব ওইটা দেখতেও সবাই মিলেই যাওয়া হলো। আমার কেমন লেগেছিলো পরিষ্কার মনে নেই তবে বড়দের দেখাদেখি আমিও বলছিলাম, এই সিনেমাটা খুব ভালো হয়েছে! যদিও আমাদের পিচ্চীদের কাছে "দুই জীবন"ই বেশি ভালো লেগেছিলো।
এরপরে বিরাট একটা সময় মনে হয় হলে গিয়ে কোন সিনেমা দেখা হয় নি। বাবার কলিগরা একেকজন নানান জেলায় ট্রান্সফার হয়ে গেলো। সেই চমৎকার গেট টুগেদার গেলো বন্ধ হয়ে। আমরাও হয়ে উঠতে শুরু করলাম একটু একটু করে বড়। এবং সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, শোনা গেলো সিনেমাহলের পরিবেশ এবং দর্শক সবই নাকি খারাপ হতে শুরু করেছে। এই সব নানান কারণে বাংলা সিনেমার প্রতি আকর্ষন সবারই কেন যেন একটু একটু করে কমতে শুরু করলো।
(চলবে)
অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের বাসায় সাদাকালো টিভি ছিলো। তখন টিভিতে দেখানোও হতো বেশিরভাগ সাদাকালো ছবিই। নায়ক-নায়িকা হয় রাজ্জাক-কবরী-ববিতা নয়ত শাবানা-আলমগীর, কখনও শবনম-রহমান। এর বেশি নিজের মনে নেই, তবে আমার মায়ের খুব পছন্দের ছিলো নায়িকা ছিলো সুজাতা। এক্কেবারে পিচ্চীবেলার সিনেমাগুলো বিটিভিতে দেখাতো বৃহস্পতিবার রাত আটটার সংবাদের পরে। আমরা সবাই সার বেঁধে ড্রইং রুমে বসে যেতাম। দেড় ঘন্টা দেখার পরেই ইংরেজী সংবাদ, মানে আধ ঘন্টার বিরতি। সেই সময়েই ঘটতো করুণ ঘটনা। আমার বাবা আমাকে নানান ভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করত। একেক দিন একেক অজুহাত, "মা, আজকে তো আর দেখাবে না, পরের অংশের ফিতা নষ্ট হয়ে গেছে", অথবা "আরে এইটা শুক্রবারে সকালে আবার দেখাবে তখন দেখো" ইত্যাদি নানা অজুহাত। সেই সব স্বপ্নময় সাদাকালো সিনেমাগুলো আমার কখনই তাই দেড় ঘন্টার বেশি দেখা হয় নি।
তার বেশ কিছুদিন পরে বোধহয় শুক্রবারে সিনেমা দেখানো শুরু হলো। মাসে এক শুক্রবারে বাংলা সিনেমা, বাকি শুক্রবারগুলোতে "মুভি অব দ্য উইক"। ওই এক শুক্রবারের জন্য হা করে বসে থাকতাম। তখন কিছু কিছু রঙীন সিনেমা দেখানো শুরু হলো, কিন্তু আমাদের তো সেই সাদাকালো টিভিই। একটু মন খারাপ হতো, কিন্তু কিছু বলতাম না। কিন্তু যেদিনই আবার সাদাকালো সিনেমা হতো, সেদিনই খুশিমনে বলে উঠতাম, " খুব ভালো হইসে, যাদের বাসায় রঙীন টিভি, আজকে তারাও সাদাকালো দেখবে"!
হলে গিয়েও সিনেমা দেখেছি, প্রথম কোনটা মনে পড়ছে না। তবে অনেক ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম "ভেজা চোখ"। ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা , মিঠুন, শিশুশিল্পী জয়া আর মনে হয় দিতি নাকি নিপা মোনালিসা নিশ্চিত নই। চমৎকার সব গান ছিলো। "জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প", "তুই তো কাল চলে যাবি আমাকে ছেড়ে/পরশু কি হবে দেখা এমন করে","প্রিয়া আমার প্রিয়া","পেয়েছি চাচী পেয়েছি ও চাচা" এইগুলো মনে পড়ছে। সিনেমা দেখে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে ফেলেছিলাম। পত্রিকার একটা রিপোর্টের শিরোনামও মনে আছে হুবুহু, "ভেজা চোখ দর্শকদের চোখ ভিজিয়েছে"। এখন দেখলে কেমন লাগবে জানি না কিন্তু তখন অসাধারণ লেগেছিলো। চম্পা বোধহয় নতুন এলেন তখন সিনেমায়, আমার কাছে চম্পা-ইলিয়াস কাঞ্চনকে খুবই স্মার্ট লাগতো তখন। :)
প্রায় সমসাময়িক কালে আরো দুইটা সিনেমার কথা মনে পড়ে যেগুলো হলে গিয়ে দেখেছিলাম। মফস্বল শহরের ছোট্ট গন্ডির মজা হচ্ছে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। আর এর মাঝেও যারা কোন কারনে কাছাকাছি থাকে, তাদের আত্মীয়তা বেড়ে যায় আরো অনেক বেশি। আমার বাবা ব্যাংকার। বাবার কলিগদের এবং তাদের পরিবারের মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। এই সব কলিগ-পরিবারের একটা গেট টুগেদারের একটা অংশ ছিলো সিনেমা দেখা। হলের দোতলায় আলাদা একটা রুম ছিলো, কি জানি বলতো ওইটাকে, ডিসিই কিনা? ওই রুমটা রিজার্ভ করে আমরা অনেকগুলো পিচ্চী-পাচ্চী এবং আমাদের বাবা-মায়েরা মিলে দেখতে গেলাম ওই সময়ের মহা-হিট সিনেমা "দুই জীবন"। আফজাল-দিতি, বুলবুল আহমেদ-কবরীর অভিনয়, আবদুল্লাহ-আল-মামুনের পরিচালনা। মজার সিনেমা। আমাদের সব পোলাপানেরই খুব পছন্দ হয়েছিলো। এই সিনেমারও চমৎকার সব গান ছিলো, "তুমি আজ কথা দিয়েছো, বলেছো", "একদিন তোমায় আমি না দেখিলে, তোমার মুখের কথা না শুনিলে","তুমি ছাড়া আমি একা, পৃথিবীটা মেঘে ঢাকা","আবার দু'জনে দেখা হলো, কথা হলো","আব্বু আমার বন্ধু, আম্মু খেলার সাথী, একটি ঘরে জ্বলছে যেন তিনটি সুখের বাতি"...। শেষের এই গানটা মোটামুটি আমার জাতীয়সংগীত হয়ে গিয়েছিলো।
এই সিনেমা দেখার সময় বড়দের আলাপে শুনলাম আফজালের সংগে পাল্লা দিয়ে সুবর্ণা মুস্তফাও একই সময়ে আরেকটি সিনেমা করেছেন, নাম "স্ত্রী"। আম্মু, চাচীরা "স্ত্রী" সিনেমাটি দেখতে খুবই উদগ্রীব হয়ে উঠলেন, অতএব ওইটা দেখতেও সবাই মিলেই যাওয়া হলো। আমার কেমন লেগেছিলো পরিষ্কার মনে নেই তবে বড়দের দেখাদেখি আমিও বলছিলাম, এই সিনেমাটা খুব ভালো হয়েছে! যদিও আমাদের পিচ্চীদের কাছে "দুই জীবন"ই বেশি ভালো লেগেছিলো।
এরপরে বিরাট একটা সময় মনে হয় হলে গিয়ে কোন সিনেমা দেখা হয় নি। বাবার কলিগরা একেকজন নানান জেলায় ট্রান্সফার হয়ে গেলো। সেই চমৎকার গেট টুগেদার গেলো বন্ধ হয়ে। আমরাও হয়ে উঠতে শুরু করলাম একটু একটু করে বড়। এবং সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, শোনা গেলো সিনেমাহলের পরিবেশ এবং দর্শক সবই নাকি খারাপ হতে শুরু করেছে। এই সব নানান কারণে বাংলা সিনেমার প্রতি আকর্ষন সবারই কেন যেন একটু একটু করে কমতে শুরু করলো।
(চলবে)
Comments
বি:দ্র: আমার আশপাশে আজকাল আর বইপড়া মানুষ পাচ্ছি না, সবাই শর্টকাট পছন্দ করে, তাই ভাবছিলাম আমি হয়ত নস্টালজিয়ায় ভুগছি, আপনার বই পড়ার অভ্যাস দেখে ভাল লাগল--অন্তত আরেকজন প্রগৈতিহাসিক মানুষের খোঁজ পেয়ে..হা:হা:হা:
আর বই পড়ার বিষয়টা...হুম, অনেকেই পড়ে না, আবার অনেকেই পড়েও কিন্তু। এটা বরাবরই ছিলো, সবকালেই। যারা পড়ার তারা ঠিকই পড়ে, যারা পড়ার নয় তারা কখনই পড়ে না।
আপনি পড়ুন, অন্যদের কথা না ভেবেই। শুভেচ্ছা।
সিনেমাগুলো আসলেই সুন্দর.....
www.tusin.wordpress.com
সময পেলে আমার ব্লগে একটু ঘুরে আসবেন।