কি সন্ধানে যাই সেখান আমি...

(গত কয়েক দিনের বিচ্ছিন্ন দিনলিপি)

তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না
দুই তিন ধরে একটু সকালে উঠার অভ্যাস করছি। একটু হালকা নাস্তা করি, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সচলায়তনে লগ-ইন করি, পড়তে থাকি। ফেসবুকে ঢুঁ মেরে হোমপেজে বন্ধুদের আপডেট দেখি। এই-ই ভালো লাগে তবু মাঝে কিছুক্ষণ রান্নাঘরের রঙীন মশলাপাতি আর চাল-ডাল-পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। ভাবছি, সকালে উঠতে পারাটা দারুণ ব্যাপার। প্রয়োজনের বাইরের কাজগুলো আয়েশী ভঙ্গিতে করে নেবার সময় পাওয়া যায়।

দেশ থেকে বই এসেছে অনেকগুলো, অনেক দিন পর নতুন বই হাতে নিলাম- কি যে আনন্দ! "সচলায়তন সংকলন" নিয়ে টুকটাক কিছু অভিযোগ শুনেছিলাম, ফন্ট বেশি ছোট হয়েছে, কাগজের মান তেমন ভালো নয়-এসব। আমার তো মনে হলো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বইটা হাতে নিয়ে বসে আছি। কি চমৎকার প্রচ্ছদ। ক্ষুদ্র অক্ষরগুলো দেখে ভাবি আহা কি চমৎকার গুটি গুটি হরফে ছাপা। বইমেলা নিয়ে বরাবরই আমার উচ্ছ্বাস অনেক বেশি, এবারেরটা আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিলো, খুব কাছের মানুষদের বই ছাপা হয়েছে বলে। আর এমন কপাল, এবারই প্রথম বইমেলায় থাকতে পারলাম না। তখন থেকেই অপেক্ষায় আছি। কিন্তু "সচলায়তন সংকলন" আজিজে খুঁজে পাওয়া গেলো না, আগেই বইমেলা থেকেই যেটা কেনা হয়েছিলো সেটাই পাঠিয়ে দিয়েছে আমার বোন। এসেছে নজমুল আলবাব ভাইয়ের "বউ, বাটা, বল সাবান", আরিফ জেবতিক ভাইয়ের "তাকে ডেকেছিলো ধূলিমাখা চাঁদ", মুর্তালা রামাতের "কষ্টালজিয়া", সুমন রহমানের "গরিবি অমরতা", "সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া"। মাঝের থেকে কেমন করে যেন অমিত আহমেদের "গন্দম" এলো না, কেনা হয়েছিলো তো ঠিকই-মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আহমেদুর রশীদ ভাইকে এখানে একটা বিশাল ধন্যবাদ দিতেই হবে, আমার বোন খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রশংসা করলো তার। আজিজে ঘুরে আপু খানিক হিমশিম খাচ্ছিলো এই স্পেশাল বইগুলো খুঁজে পেতে। "শুদ্ধস্বর"-এ যাবার পর বইয়ের নাম শুনে রশীদ ভাই জানতে চাইলেন কাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে। ভাগ্যিস আমি ছদ্মনামে লিখি না, তাই চিনতে পারলেন (কনফুর নাম তারেক বলাতে চিনে নাই :) )।


হিমালয়ের কাছের কিছু মানুষ
আমার কাজের জায়গায় দক্ষিন এশীয়দের মিলন বসে। আমি একজনই বাংলাদেশি এবং বাঙ্গালী। ভারতীয় আছে বেশ কিছু, একজন পাকিস্তানী, একজন শ্রীলঙ্কান, একজন নেপালী। খুব সম্প্রতি আরো দু'জন নেপালী যোগ দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া আসতে পথে প্রথম যে ভিনদেশীর সাথে আমার পরিচয় হলো, সে ছিলো একজন নেপালী, অবধারিতভাবে ভীষন সুন্দরী (আজ পর্যন্ত যত নেপালী মেয়ে দেখেছি সবাই মারাত্মক সুন্দরী, মনীষা কৈরালাকে দিয়ে শুরু!)।

বাংলাদেশ থেকে মেলবোর্ণ আসার পথে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ৭ ঘন্টার দীর্ঘ ট্রানজিটে একলা একলা কিছু করার ছিলো না, ছোট লাগেজটায় তাই বই ছিলো দু'টো সংগী হিসেবে- অবশ্যই ছোট গল্পেরঃ একটা আবু ইসহাকের, গত বইমেলা থেকে কেনা; আরেকটা গী দ্য মোঁপাসার। আবু ইসহাকের বইটা খুলে পড়া চলতে চলতে দেখি একটা মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমার সামনে এসে থেমে গেলো। আমি বসেছিলাম সি ১ গেটের পাশে, বেঞ্চিতে। ওই গেট দিয়ে নেক্সট ফ্লাইট ধরতে হবে। জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রায় একা থেকে, কোন ভুল করে বিপদে পড়তে চাই নি। তাই প্লেন থেকে নেমেই প্রথম কাজ ছিলো ইন্টারনেটে বসে খবর পৌঁছে দেয়া, আর তারপরেই আমার টার্মিনাল খুঁজে বের করে ধারেকাছে বসে থাকা। মেয়েটা বন্ধ সি১ গেট বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার চেষ্টা করে হতাশ হয়ে আমার পাশে বসে পড়লো। গন্তব্য কোথায় জিজ্ঞেস করতে জানায় মেলবোর্ণ। এইবার আমি বেশ একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলি, আমিও। সে খানিক ভরসা পেলেও ততোধিক দুশ্চিন্তায় বলে, আমাদের টার্মিনাল গেট বন্ধ হলে যাবো কি করে। আমি ভাবি কি পরিমান সরল একটা মেয়ে। তাকে বুঝাই তখনও আরো ৬ ঘন্টা বাকি ফ্লাইটের, গেট এখনই কেন খোলা থাকবে? এবার সে খানিক শান্ত হয়। একটু একটু করে আলাপ চলতে থাকে। নাম গীতা পন্ত। আমার মত তারও প্রথম বিদেশযাত্রা। কপালে (সিঁথিতে নয়) বেশ বড়সড় লাল সিঁদুরের প্রলেপ। জানা গেলো সে নেপালী, আসবার আগে মা পূজো করে আশীর্বাদ স্বরূপ এই চিহ্ন দিয়ে দিয়েছে। এই ৬ ঘন্টা টুকটুক করে অনেক কথাই হলো, সে খুব চিন্তিত তার দুর্বল ইংরেজী নিয়ে। মেলবোর্ণ পৌঁছেই আগে ইংরেজী শেখার কোন কোর্স করবে ঠিক করেছে। এক ফাঁকে গীতা তার ব্যাগ থেকে বেশ কিছু চুড়ি বের করে আমাকে দিলো স্মৃতি হিসেবে। আমি মোটামুটি ভ্যাবলা হয়ে দেখি তাকে দেবার মত এরকম কিছুই নেই আমার কাছে। বাংলা সাহিত্য তো আর দেয়া যায় না! মেলবোর্ণ আসার পাঁচ মাস পর হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা হলো আবার গীতার সাথে, ফোন নাম্বার পেয়েছি-তবু যোগাযোগ হয় না।

গীতার কারনেই নতুন আসা নেপালী মেয়েটাকে দেখে খুব খুশি হলাম। ইনিও মাশাল্লাহ সুন্দরী, আমার চেয়ে অনেক ছোট বয়সে, নাম রেটিনা। প্রথম ক'দিন খুব মন খারাপ করে থাকতো। কাজের মাঝে বিরতিতে নানাভাবে তার মন ভালো করার চেষ্টা করতে করতে বলি, এখানে আরেকজন নেপালী ছেলে আছে, মানীশ। আবার মানীশকেও বলি, নতুন একটা নেপালী মেয়ে এসেছে। শুনেই ভারতীয় ছেলেগুলো মানীশকে ক্ষেপানো শুরু করলো, মানীশ তো গার্লফ্রেন্ড পেয়ে গেলো। দু'দিন পর দেখা গেলো সত্যিই তাদের খুব ভাব হয়ে গিয়েছে। বেশ একটা আজব অনুভূতি হয়, দু'জনের মিল করিয়ে দিয়েছি ভেবে।


মায়াবতী দিদি আমাদের
সূচেতা দিদির বাসার এলে কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে যাই একটু বেশি। এখানে সবাই খুব বেশি বড় হয়ে যেতে চায়, স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলোরও ইউনিফর্ম না পড়লে বয়স বুঝার উপায় নেই। আর সেখানে আমি তো জীবনের দুই যুগ পার করে আরো এগুচ্ছিই ক্রমাগত। বড় বড় ভাব নিতে হয়। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে হয়। অন্যদের সাথেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়। নয়ত আর কি?এখানে কোথায় পা'ব বাবাটাকে। কোথায় পা'ব পাশের বাড়ির প্রিয় খালাকে...কে করবে ছেলেমানুষ ভেবে অনেক বেশি আদর আর সেইসাথে শাসন? এই একজনই আমাদের, সূচেতা দিদি। এই এখন দিদির বাসায় এসে দিদি খাবার-দাবার রেডি করছে আর আমি দিদির পিসি কিবোর্ডে হাত চালাচ্ছি। অন্য যেকোন বাসায় গেলে নির্ঘাত বেশ দায়িত্বশীল ভাব নিয়ে রান্নাঘরে আর খাবার টেবিলে সাহায্য করতে যেতাম। মাত্রই দিদি খানিক ভর্তসনাও করে গেলেন কম্পিউটারে এডিক্ট হয়ে গিয়েছি বলে। এই একটুখানি বকাও যে কত ভালো লাগে! এখন বকা খাচ্ছি, একটুপরে খাবো খিচূড়ী। আহা নিজে না রেঁধে খেলে খিচূড়ীর মজা যে কতখানি বেড়ে যায়!

দিদির বাসায় টুকটুক করে কত কি সাজানো। দু'টো ঘোড়া আছে, দারুণ। একটার পিঠে আবার জিনও আছে, আছে পা রাখার জায়গা, যেন এক্ষুনি কেউ ওতে পা রেখে ওর পিঠে চড়ে বসবে, তারপর টগবগ টগবগ...। অথবা যদি ওর একটা ডানাও থাকতো পক্ষিরাজের মত! সবার অলক্ষ্যে আমি কি ঘুরে আসতে পারতাম আমার সবুজ দেশটা?

পাগলা ঘোড়া রে, কই থেইকা কই লইয়া যাস...
আমার ব্যাচের পোলাপানের মাস্টার্স শেষ হলো মাত্র ক'দিন আগে ঢাকা ইউভার্সিটিতে, থিসিস-এর কাজ চলছে। ই-চিঠিতে যোগাযোগ হয় এক বন্ধুর সাথে। ভালো রেজাল্ট হবে তার সন্দেহ নেই, তাই পরামর্শ দিই মাস্টার্স-এর পরে বাইরে কোথাও পড়তে যাবার, স্কলারশীপের জন্য যেন চেষ্টা করে। সে-ও জানায় তাই ভাবছে। তারপরের লাইনটাই চমকে দেয় খুব- "অদ্ভুত তুই বাইরে গিয়ে ভাবছিস দেশে কবে আসবি আর আমি দেশ থেকে বাইরে যাবার কথা ভাবছি। এজন্যই মুজতবা আলী বলেছিলেন, বাঙ্গালীরা বড় বেইমান প্রকৃতির, কখনও দেহমনের সহাবস্থান করতে জানে না..."।

কি অদ্ভুর নিয়ম। আমরা যা ইচ্ছে তাই করছি ভেবেও আসলে কি দারুণ পুতুল হয়ে বসে আছি প্রকৃতির। ইচ্ছেগুলোও কি দারুন বদলে দেয় একেকটা পরিবর্তিত পরিস্থিতি। প্রবাসে কনকনে ঠান্ডায় নিজেকে নানান শীতবস্ত্রে ড়্যাপিং করে, দারুন ভালো গতির ইন্টারনেটে এখানে সেখানে ঘুরে অতঃপর নিজের পাতায় টাইপ করতে করতে লক্ষ্য করি আজ ২৯শে জুলাই। ঠিক একটা বছর হয়ে গেলো এই ভিনদেশে! দীর্ঘ ৩৬৫ টা দিন!! তবুও দেহমনের সহাবস্থান করা হলো না।

Comments

Anonymous said…
আপনার লেখাগুলো পড়ছি.. ভাল লাগল...
শুভেচ্ছা জানবেন।
toxoid_toxaemia said…
লেখাগুলো সচলেই পড়েছিলাম, আবারো পড়লাম আপুনি। সবগুলো লেখা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। আবারো ভাল লাগার অনুভূতিটা ছুঁয়ে গেল।
যাক... সুমন রহমানের বই আপনার হাত পর্যন্ত এসেছে। ভালো লাগল... ‌"অসৎ" লেখকের ভালো লাগা আর কি....

ভালো থাকুন।
onek onuvhuti ache ja prokash korar jonno shobder talika furiye jai. ami jodi apnar likhar shunam korar jonno hajaro bisheshon bebohar kori tarporo kom hobe. chomotkar laglo.
সুমন ভাই,
আপনার লেখা আমার বরাবরই ভালো লাগে, খুব বেশিই ভালো লাগে। গল্প এবং কবিতা- এই দুই বিষয়েই আপনার লেখার রীতিমত ভক্ত আমি। এবং আমার সংগীটিও। মূলত সেই খোঁজ করে আপনার বইয়ের নাম বের করেছে। এবারের বইমেলায় ব্লগের মাধ্যমে নিজেদের চেনাজানা লেখকদের বই বের হওয়াতে অনেক বেশি আনন্দিত ছিলাম আমি, চেষ্টা করেছি সবার বইই এত দূরে হলেও নিয়ে আসতে।
আমি আপনাকে বোধহয় কখনও "অসৎ" লেখক বলি নি...তবে হ্যা, আপনার কিছু আচরনে কষ্ট পেয়েছি, যখন সেইটুকু না বললে হিপোক্রেসী হয়ে যায়, সেটা বলেছি। আমি এরকমই। আমাদের প্রত্যেকেরই বোধহয় মানুষ হিসেবে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গিয়েছে, নিজের কথাই বলছি। তার মানে এই নয় যে লেখক হিসেবে আপনার প্রতি আমার ভক্তি কমেছে এতটুকু।
আপনি অনেক ভালো থাকুন। আপনার চমৎকার সব লেখা চালিয়ে যান, (এমনিতেই যাবেন জানি)। আপনার ব্লগের ঠিকানা পেয়ে খুব ভালো লাগলো। আর দেরিতে উত্তর দেবার জন্য দুঃখিত।
inanwrites,
অনেক ভালো লাগলো আপনার ভালো লেগেছে জেনে।

এনাম,
তুমি সময় করে নিয়মিতই আমার ব্লগে আসো দেখ খুব ভালো লাগে। আমারই তো তোমার চেয়ে অনিয়ম হয়ে যায় মনে হয়!

মিনা,
আমি খুবই দুঃখিত এত দেরি করে আপনাকে উত্তর লিখছি বলে। আপনার এতটা ভালো লেগেছে জেনে সত্যি আনন্দ হচ্ছে। অনেক ধন্যবাদ আমার ব্লগে সময় দেবার জন্য।

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

দ্বিধা

রাহেলা