পারি না

অসংখ্য মানুষ। এই শহরে এত মানুষ একসাথে আমি কখনও দেখি নি। কিছু একটা গড়বড় হয়েছে নিশ্চয়ই। ভাবার সময় নেই, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে অফিসে পৌঁছুতে হবে। ডানে ঘুরতেই পুলিশ থামায়, যাওয়া যাবে না। আমি অবাক, হাত দিয়ে সামান্য দূরেই দেখিয়ে বলি, "আমার অফিস ওই তো, পাঁচ পা হাঁটলেই"। "না না, যাওয়া যাবে না, অন্য রাস্তায় যাও"। আমি বুদ্ধি করে রাস্তায় অন্য পাশে যাই, না সেদিক দিয়েও রাস্তা বন্ধ। এবার একটু ঘাবড়ে যাই। এই দেশে বেশি দিন হলো আসি নি, সিটির চেনা জায়গা বলতে আমার এই অফিসখানাই। বাসে করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নেমে নির্দিষ্ট দু'টি পথ পেরিয়ে আমার অফিস। এর অন্যথা হলেই আর জানি না।

ক'জন পুলিশকে জিজ্ঞেস করি, কোন দিক দিয়ে ওখানে যাওয়া যাবে। প্রথম দু'জন ডিউটি নিয়ে ভীষন ব্যস্ত, আমাকে সময় দিতে অপারগতা জানালো। তৃতীয় এবং চতুর্থজন খানিকটা নির্দেশনা দিলো, একই রকম। ভাবলাম পেয়ে যাবো। কিন্তু ভাবলেও আমি জানি, কাজ হবে না- আমি আসলে পারবো না। রাস্তা আমি কখনও ভালো করে চিনি না। একই রাস্তা দিনের পর দিন, এমনকি বছরের পর বছর ক্রমাগত গেলেও ভুল করে ফেলি তবু। ছোটবেলায় বাড়ি থেকে স্কুলের পথ ভুল করেছি কত, অথচ এইটুকুনি পথ ছিলো সেটা। কখনও কোথাও একা গেলেই সব হারিয়ে ফেলতাম, একা কখনও ছিলামও না অবশ্য, মা ছিলো না সাথে সব সময়? নয়ত ছোট আপু, নয়ত বড় আপু, নয়ত বাবা। মফস্বল থেকে যখন ঢাকায় যাই, কতবার ভুল করে কার্জন হল পেরিয়ে রিকশা নিয়ে চলে গেছি পুরান ঢাকার দিকে। কিন্তু পরিবার থেকে দূরে গেলেও পরম বিশ্বস্ত বন্ধুর হাত পেয়ে গিয়েছি সেখানেও। চোখ বন্ধ করে পরম নির্ভরতায় পার হয়ে গেছি কত শত মাইল, সেই হাত ধরে। মফস্বলের এই আমার ঢাকা শহরের হালচাল খানিক বুঝতেই কেটে গেলো কতগুলো বছর। হায়, এই বিদেশ বিভুঁইয়ের হালচাল বুঝতে কতদিন লাগবে কে জানে?

ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাবার মুখটা খুব মনে পড়ে। বাবার হাতটা ধরতে ইচ্ছা করে...। ওমনি মোবাইলে অর্ণব গেয়ে ওঠে, "তোমার জন্য নীলচে তারার একটুখানি আলো"...তার বিশেষ রিংটোন, ভীষণ চিন্তায় আছে, আমি হারিয়ে যাই কিনা ভেবে। "তুই মাথা ঠান্ডা কর, আমি বলে দিচ্ছি কোন দিক দিয়ে গেলে পাবি।" ও খুব সুন্দর করে রাস্তা বলে দেয় আমাকে...কিন্তু আমি কিছুই বুঝি না। এবার সত্যি খুব অসহায় লাগে আমার। এত্তগুলো মানুষের মাঝখানে নিজেকে খুব বেশি একলা মনে হয়। সে আবার ভরসা দেয়, "মাথা ঠান্ডা কর, আমি আবার বুঝিয়ে বলছি।" কিন্তু জটিল পরিস্থিতিতে মাথা আমার কখনই ঠান্ডা হয় না। বরং আরো জেদ চেপে যেতে থাকে। কেন আমার সব সময় এমন হয়? কেন আমি সব ভুল করি? আমি খুব রাগী রাগী গলায় তাকে ঝাড়ি দিই, " তোর কথা কিছু বুঝছি না আমি, আমাকে একটু নিজে নিজে খুঁজতে দে। আমি পাঁচ মিনিট পরে ফোন করি তোকে।" বলে ফোন কেটে দিই। ও খুব ভালো করে জানে রাস্তা খুঁজতে গিয়ে আমি উল্টো সব হারিয়ে ফেলব। কিছুক্ষন পরেই আবার ফোন ওর। আমার কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছা করে না। ফোন কেটে দিই। আবার ফোন। আবার। আমার মনে হয়, আমি কারো কথায় কিছু বুঝব না, আমার মাথায় যে ওসব কিছুই ঢুকছে না। আমি শুধু জানি, বার্কস স্ট্রিট, কলিন্স স্ট্রিট, ফ্লিন্ডারস লেন। এর বাইরে সব কেমন গুলিয়ে-পেচিয়ে কিলবিল করে আমার মাথায় ঘুরতে থাকে।

আবার আমার দেশের কথা মনে হয়, মা'র কথা, "মামণি, সাবধানে রাস্তা পার হয়ো!" ছোটআপুর কথা মনে হয় যে আমার হাতটা বড় আদর নিয়ে ধরে রেখেছে যেন হাঁটতে হাঁটতে। আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। এ শহর আমার নয়। এই শহরের মানুষদের আমি চিনি না...সারি সারি গাড়ি, ট্রাম, বাস, বাইসাইকেল--কোনকিছুই আমার আপন নয়। ঠিক কোন পথ ধরলে ফের অফিসটা খুঁজে পাবো জানি না। আমার হঠাৎ করে কেন যেন জানতেও ইচ্ছা করে না। ক্রমশ একলা-অসহায় লাগতে থাকা অনুভূতিকে আমি ইচ্ছে করেই বাড়তে দিই। আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। চোখ বন্ধ করি। দু'পাতায় চাপ লেগে জমে থাকা পানির একটি ফোঁটা টুপ করে পড়ে আমার গাল বেয়ে অচেনা পরিচ্ছন্ন রাস্তায়। আমি হাঁটতে শুরু করি, কোন দিকে নিয়ে যাবে এই পথ জানা নেই।

------------------------------------------------------------------------------------------
না, হারিয়ে যাওয়া আমার হয় না। ভালোবাসার পিছুটান আবার ঠিকই হাতটা ধরে ফেলে।

Comments

toxoid_toxaemia said…
ইচ্ছে করলেই তো হারিয়ে যাওয়া যায়না আপুনি তাইনা!!!যাই হোক, আজকে তোমার জন্মদিন তাই এসব আজেবাজে কথা না বললেও চলবে।আগামী দিনগুলোতে যেন কোন বাঁধাই তোমার অগ্রযাত্রায় পথ আগলে দাঁড়াতে না পারে সেই দোয়া করি সবসময়।নিশ্চয়ই প্রিয়জনের সাথে অনেক আনন্দে কাটাচ্ছ আজকের শুভদিন।তোমার জন্য অন্তরের গভীর থেকে জানাই শুভেচ্ছা ও শুভকামনা সবসময়ের জন্য।ভাল থেকো।
toxid,
তোমার একটা বাংলা নাম বল তো ভাই, সেই নামেই ডাকবো নাহয়।
হুম, জন্মদিন ভালোই কেটেছে বেশ। ভালো লাগলো তোমার শুভেচ্ছা পেয়ে।
toxoid_toxaemia said…
আমাকে এনাম বলে ডাকতে পারো।নাম তো বলে দিলাম।মনে থাকবে তো তোমার ??
সৌরভ said…
পড়লাম। দেরিতে।
Anonymous said…
বারবার পড়ার মত লেখা। আপনার অনুভূতির গভীরতায় আমি সত্যি আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি আপনার লেখার হাত আছে।
Anonymous said…
The sun also rises tomorrow...
শুভকামনা।
সৌরভ,
হুমম।

অগ্নি,
ব্লগস্পটে অচেনা মানুষগুলোর মন্তব্য কতখানি অনুপ্রাণিত যে করে। অনেক ধন্যবাদ।

শিমুল,
আপনি দেশে গিয়ে কেমন জানি দূরে চলে গেছেন, কি মুশকিল বলেন তো?

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

দ্বিধা

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ