বন্ধু

সূর্য ডুবে যাবার অল্প কিছু সময় পর থেকে বারান্দায় এসে বসে আছেন জামাল সাহেব।

বয়স বাড়ছে আর প্রতিটা দিনের দৈর্ঘ্য বুঝি বেড়ে যাচ্ছে সমানুপাতিক হারে। অবসর নেবার পর এই সাড়ে তিন বছরে ধীরে ধীরে শরীরটায় কেমন বুড়ো বুড়ো একটা গন্ধ টের পান তিনি। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর। এখন হাতে থাকা অফুরন্ত সময়ের অধিকাংশই কাটে অলসভাবনা আর বিগত দিনের দেনা-পাওনার হিসেব কষে। আর সময়ের সাথে সাথে সবার থেকে একটু একটু করে আলাদা হয়ে যেতে থাকেন তিনি।


জামাল সাহেবের তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে আর মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, ছোটটি কলেজে। তিন ছেলেমেয়ে আর জামাল সাহেব ছাড়া এই বাড়িতে শেষ সদস্যটির নাম বাদশা- তাদের বাসার কাজের ছেলে। এক বছর আগে তিনি বাদশাকে পেয়েছিলেন কাঁচা বাজার করার সময়। সাত/ আট বছরের ছেলেটা রোজ তার বাজারের ব্যাগ টেনে দিতো। কাজ শেষে বখশিশ পেয়ে তার মুখ ভরে উঠতো নির্মল হাসিতে। টুকটাক কথায় জানা গিয়েছিলো তিনকূলে তার কেউ নেই, বাজারে ব্যাগ টানার এই কাজ করেই কোনমতে চলে। জামাল সাহেবের বড় মায়া হয়। একদিন কি ভেবে একেবারে বাসায়ই নিয়ে এলেন তাকে।

লাল আভা কেটে গিয়ে অন্ধকার গাঢ় হতে শুরু করেছে। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনোয়ারার কথা মনে পড়ে জামাল সাহেবের। সারাদিন অফিস শেষে এই বারান্দার মুখোমুখি দু'টি চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে গল্প করার সুখময় সময়গুলো কি সত্যি কখনও ছিলো তার জীবনে? চোখ ভরে আসে জলে। খুব বেমানান আবহ সংগীতের মত বড় ছেলের ঘর থেকে ভেসে আসছে তুমুল হুল্লোড়, বন্ধুদের নিয়ে পার্টি হচ্ছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই রোজকার মত এই সময়টায় মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। ছোট ছেলের সামনে পরীক্ষা, নিজের বাসায় তার পড়া হয় না বলে নাকি বন্ধুর বাড়িতে থেকে আজ সারারাত পড়বে। বারান্দার চেয়ারটায় একলা বসে থেকে জামাল সাহেবের বড় শূণ্য লাগে চারপাশটা।

ঠিক এই সময় সামনের গোল টেবিলটায় চা-ভর্তি একটা কাপ আর দু'টো টোস্ট নামিয়ে রেখে তার সামনে মেঝেতে বসে পড়ে বাদশা। এক মুহুর্ত যায়। আরো কিছু মুহুর্ত কাটে নীরব চাহনিতে। কোন কথা হয় না, তবু কি যেন বলা হয়ে যায় তাদের।

----------------------------------------------------------------------------------------------------
এই লেখাটা প্রিয় সচলায়তনের ই-বুক; সচলায়তন অণুগল্প সংকলন "দিয়াশলাই"-এর জন্য লেখা। ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য এখানে তুলে রাখলাম।

Comments

toxoid_toxaemia said…
অণুগল্পগুলো ছোট্ট হলেও কিভাবে এত সুন্দর করে যে কত কথা বলে ফেলে!!নিজেরই অবাক লাগে তোমার মতন গল্পকারদের শৈল্পিক নৈপূণ্য দেখে।ভাল লাগল।
ওরিব্বাবা। থ্যাঙ্ক ইউ ডিয়ার।
toxoid_toxaemia said…
তোমার জন্যেও আন্তরিক শুভকামনা।

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

নজমুল আলবাবের " পাতা ঝরার আগের গল্প" - আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা স্মৃতির চর্বণ

ক্যাফের শহর মেলবোর্ন