বলিও আমার পরদেশীরে

টুক টুক করে যেতে যেতে তারপর বেশ ঘট ঘট করেই চলে যায়- সময়। এটা সেটা ভাবি, সেইসব জঞ্জাল নিয়ে লিখব বলেও ভাবি, লিখা হয় ওঠে না। কতটা সময় গিয়েছে মাঝে? উত্তর জানতে কষ্ট করে পেছনে তাকাতে হলো না, ডানে "সাম্প্রতিক লেখা" তে একটা ক্লিক করেই জানা গেলো, শেষটা ছিলো গত নভেম্বরে! খুব টান পড়েছে সূতোয়, একটু আলগা করার চেষ্টা করেই দেখি না।

কিন্তু অনেক দিনের বিচ্ছিন্নতায় কেমন আড়ষ্টতা পেয়ে বসছে। এখন কি এসব লিখতে পারবো? এই রোজকার আটপৌরে জীবন নিয়ে? ও তো সবাই পার করে, রোজ। তবু লিখব আজ, কিছু একটা, ভীষন এলোমেলো করেই নাহয়। আজ আবার সচল হবো।
লিখবো কেমন পাখির মত উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছি... "তোমরা রেকর্ড করে ফেলেছো, গত আট মাসে তিনটা ভিন্ন বাসায় থাকছো!"। আমি হাসি। "পরের জায়গা পরের জমি, ঘর বানাইয়া আমি রই/ আমি তো ভাই জমির মালিক নই"। এই ভিন দেশ, তার আবার বাড়িঘর, ভাবি "একখানে থাকলেই হইলো"। উহু, তাও কেমন যেন নির্লজ্জের মত মায়া পড়ে যায়, মানুষ হবার জ্বালা। এসব কি কেউ লিখে?

[গাড়ি খানিক চলছে বোধ হয়, অনেক দিন পরে তেল পড়ে লাফাচ্ছে, কখন দড়াম করে হোচট খায় তাই ভাবছি!]

অফিস যাবার রাস্তাটা বদলেছে। এখন বাড়ির সামনেই বাস নয় বরং বেশ খানিকটা তাড়াহুড়া করে হেঁটে গিয়ে ট্রেন ধরি...লাগবে ঠিক ষোল থেকে সতের মিনিট, এতটা রাস্তায় একদম একা নাই বা থাকি, একটু গান থাক সংগে। আগের রাতে পিসি থেকে গনহারে বেশ কিছু গান নিয়েছি মোবাইলে, All Songs ছেড়ে দিই। স্ক্রিণে তাকিয়ে দেখি আশা ভোঁশলে গাইবেন, "সন্ধ্যাবেলা তুমি আমি বসে আছি দুজনে/ তুমি বলবে আমি শুনব"। খুশি হই, কিন্তু একি, কেউ একজন গলাকে যথাসম্ভব মোটা-চিকন করে শুরু করে, "DJ...you say I just listen to you...o babe"!! হেসে ফেলি। কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি! পরের গানে খালিদ গেয়ে যান "যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে এ হৃদয়ে সে কিছু নয়"...চলুক। এইসব হাবিজাবি হলেও আজ লিখব।

ট্রেনে উঠে হেডফোন নামিয়ে রেখে বই খুলে বসি। ইদানিং ট্রেনে চড়ার সুবাদে পড়ছি আবার। শুরু করেছিলাম শাহাদুজ্জামানের "গল্প, অগল্প, না-গল্প সংগ্রহ"। বইয়ের প্রথম সংগ্রহ "কয়েকটি বিহবল গল্প" ভালো লাগে নি তেমন। লেখার ধরনটা ইউনিক, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নতুন হলেই যে খুব ভালো লাগবে এমন কথা নেই। এই লেখাগুলো প্রসংগে প্রকাশকের একটা কথা যুতসই মনে হয়ঃ "তার কোন কোন লেখাকে অবশ্য প্রচলিত অর্থে গল্প বলা দুষ্কর। সেখানে বরং গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ তাদের পরস্পরের দেয়াল ভেঙে মিলিত হয়েছে।" এমনটাই মনে হয় আমারও। সেই অর্থে ভালোই লাগে, গল্প হিসেবে নয়। বরং কেমন একটা "ব্লগর ব্লগর"-এর আমেজ আছে যেন। কিন্তু খুব ভালো লাগে পরের বইটি, "পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ"। এই দু'টো বইতে লেখকের লেখনীতে যেন বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে, অনেক পরিপক্কতাও। শেষের বইটির প্রায় সবকটি গল্প আমার ভালো লাগে। বিশের করে গ্রামীণ পটভূমির কিছু বর্ণনা, অনুষঙ্গ দারুণ লাগে পড়তে। যেমন "ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস", "নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন"। আবার "আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা" পড়ে মনে হয় একদম দারুন একটি ব্লগর ব্লগর, গল্প নয়! পরবর্তি সংগ্রহ "ঃতে দুঃখ" আপাতত না পড়ে আমি চলে যাই উপন্যাস "ক্রাচের কর্ণেল"-এ, চলছে।

এই বই পড়তে পড়তে, ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখি পাশের সারির পাগড়ি পরা বয়স্ক এক লোক আমার দিকে মাঝে মাঝে যেন তাকাচ্ছে। আমি তাকাতে চোখে চোখ পড়তেই বলে ফেললো, "সিটি কিতনা দূর হ্যায়?" এই জাতীয় কিছু একটা। আমি হিন্দি বুঝেছি কিন্তু বলা সম্ভব না। ইংরেজিতেই উত্তর দিলাম। ভাইজান খুবই প্রসন্ন হাসি হেসে এবার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সুধান যে আমি ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চল থেকে এসেছি। অতঃপর গর্বিত বাংলাদেশী বাঙালী আমি তাকে পরিচয় জানাই। তুমুল উৎসাহে সে এবার তার সারি থেকে আমার সারিতে ঠিক আমার মুখোমুখি এসে বসে। বহুকষ্টে ইংরেজি বলার চেষ্টা করা দেখে আমি তাকে হিন্দি বলতে সায় দিই, জানাই আমি হিন্দি না বললেও মোটামুটি বুঝি। কি যে খুশি তখন তার। বলে, "আমার তো পাঞ্জাবী মিশানো হিন্দি। যাক, নিজের দেশের না হোক, তাও তুমি প্রতিবেশি দেশের। তাও তো আমার কথা বোঝ। জানো, আমি ইন্ডিয়াতে গানের শিক্ষক ছিলাম, আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে দেশে। এখানে এসেছিলাম এক বন্ধুর কাছে, ছয় মাস হলো..."। ইন্ডিয়ান ক্লাসিকের প্রতি আমার বেশ অনুরাগ। গানের শিক্ষকের সাথে কথা বলছি জেনে ভালো লাগে। ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যেই গানপাগল একটা ভাব আছে। তাকে আরো সহজ হতে জানালাম যে আমিও গান করি। জানতাম, এবার তার সরল হাসিটা আরো বিস্তৃত হবে। খুব অনুরোধ করতে লাগলেন যেন আমার "বাঙাল ভাষায়" একটা গান তাকে শোনাই। আমি হেসেই শেষ, তাকে গাইতে বলতেও ভুলে গেছি। তাতে কি ততোধিক সরলতায় ওস্তাদজি নিজেই বলেন, "ঠিক আছে, তুমি তো শোনালে না, আমি শোনাই"...সঙ্গে সঙ্গে ধরলেন একটা রাগ...ততক্ষনে স্টেশন প্রায় চলে এসেছে। কিন্তু গান শুনে আমি হতবাক। যেন পানির কলটা খুলে দেয়া হয়েছে, এমনি কলকল করে চলতে শুরু করলো তার কন্ঠ। হাত নেড়ে, মুখে পূর্ণ অভিব্যক্তি এনে ওস্তাদজি গেয়ে চললেন, কন্ঠ খাদ থেকে চড়ায়, চড়া থেকে আবার খাদে ওঠানামা করছে সাংঘাতিক মসৃণভাবে...আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। ঠিক সেই সময়েই আমাদের স্টেশন চলে আসে...গান থামিয়ে আবেগে সে আমার হাত ধরে বলে..."তুমি খুব ভালো, আবার দেখা হবে হয়ত কোনদিন, সেদিন তোমার গান শুনবই"।

ট্রেন থেকে নেমে মুগ্ধতার রেশ কাটতে সময় লাগে আমার। আহারে, নিজস্ব গানের ভুবন ছেড়ে এই মানুষটা কোথায় এসে পড়েছে এখনও বোধহয় বুঝতে পারছে না। কেউ কি বুঝবে তার এই ক্লাসিকের মূল্য?
কদিন ধরে একটা গান তোলার চেষ্টা করছিলাম গলায়, সেটাই আবার চালিয়ে দেই কানে,
"পরদেশী মেঘ যাওরে বলে
বলিও আমার পরদেশীরে..."।।

Comments

mahmud said…
কী সুন্দর লেখা!!
খুব ভালো লাগলো পড়ে......

"পরদেশী মেঘ যাওরে বলে
বলিও আমার পরদেশীরে..."

আহা! দারুণ!!
mahmud said…
This comment has been removed by the author.
Aero River said…
সুন্দর লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। এই উপমাটি বেশ হয়েছে কিন্তু। "যেন পানির কলটা খুলে দেয়া হয়েছে, এমনি কলকল করে চলতে শুরু করলো তার কন্ঠ।"

ধন্যবাদ

Bangla Hacks

Popular posts from this blog

হাত বান্দিবো পাও বান্দিবো | শাহ আবদুল করিম

দ্বিধা

রাহেলা